কালো ঘরের কান্না | ভূতের গল্প

                                        
কালো ঘরের কান্না

কালো ঘরের কান্না

রাজশাহীর এক প্রাচীন গ্রামে ছিল একটি পরিত্যক্ত, জরাজীর্ণ বাড়ি—সবাই একে ডাকত “কালো ঘর” নামে। বাড়িটি ছিল গ্রামের প্রান্তে, বড় বড় গাছপালা ঘেরা জায়গায়, যেখানে সূর্যের আলো পর্যন্ত ভালোমতো ঢুকত না। দিনের বেলা বাড়িটির দিকে তাকালে মনে হত একটা মৃত কাঠামো দাঁড়িয়ে আছে—ছাদে পিচকালো দাগ, দেওয়ালে ফাটল, জানালায় জং ধরা কাঁচ। রাতে দৃশ্যটা আরও ভয়ঙ্কর হতো, কারণ চারদিকে কুয়াশা আর সেই সঙ্গে হালকা বাতাসে জানালার কাঁচ নড়ে চড়ে অদ্ভুত শব্দ করত। কিন্তু ভয়াবহ ব্যাপারটা ছিল রাত ১২টার পর—তখন ওই ঘর থেকে আসত এক নারীর কান্না। সেই কান্না যেন কষ্টে পুড়ে যাওয়া আত্মার আর্তনাদ, একটা হারানো কিছুর হাহাকার।

গ্রামের লোকজন বলত, বহু বছর আগে এই বাড়িতে এক ভয়াবহ আগুন লেগেছিল। আগুনের সূত্রপাত কেউ জানে না, তবে আগুনে মারা যায় এক মা এবং তার ছোট্ট শিশু। কারও মতে, মা বেঁচে গিয়েছিল, কিন্তু সন্তানটি আগুনে নিখোঁজ হয়ে যায়। তারপর থেকেই নাকি মা-টি, যিনি মারা যাওয়ার পর আত্মা হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেন, প্রতিরাতে তার সন্তানকে খুঁজে বেড়াচ্ছেন সেই পোড়া ঘরের ভেতর।

এইসব গল্প সাধারণত লোকজন এড়িয়ে চলত, কারণ সবাই জানত—কালো ঘরের গল্প মানেই বিপদ। কিন্তু শহর থেকে আসা অর্ণব নামের এক কিশোর, এসব কাহিনিতে বিশ্বাস করত না। সে এসেছিল গ্রামের তার দাদুর বাড়িতে গরমের ছুটিতে। কৌতূহলী অর্ণব একদিন স্থানীয় ছেলেদের মুখে কালো ঘরের গল্প শুনে ভয় তো পায়নি, বরং খুঁজে পেল এক নতুন চ্যালেঞ্জ। সে ভাবল, ভূত বলে কিছু নেই, সবই মানুষের বানানো ভয়।

এক রাতে, চাঁদ ঢেকে গিয়েছে মেঘে, চারদিক নিরব নিস্তব্ধ, অর্ণব চুপিসারে তার মোবাইলের টর্চ জ্বালিয়ে বেরিয়ে পড়ে। গ্রামের পথ পেরিয়ে, আঁকাবাঁকা গলি ধরে হাঁটতে হাঁটতে সে পৌঁছায় কালো ঘরের সামনে। দরজা আধা খোলা, বাতাসে দরজা ঠকঠক শব্দ করছে। ভিতরে অন্ধকার, কোথাও আলো নেই। সে সাহস করে এক পা এগিয়ে দরজায় হাত রাখতেই হঠাৎ মনে হয় কেউ যেন তার ঘাড়ে নিঃশ্বাস ফেলল। সে ভয় পেয়ে পিছিয়ে আসে, কিন্তু থেমে যায় না। আবার এগিয়ে যায় ঘরের দিকে।


ঠিক তখনই, একটা ঠান্ডা হাত ধীরে ধীরে তার কাঁধে এসে পড়ে। অর্ণব দম বন্ধ করে পেছনে ঘুরে তাকায়। তার সামনে দাঁড়িয়ে এক সাদা শাড়ি পরা নারী, মুখটা নিচু, চুল ভেজা, আর চোখ থেকে জল পড়ছে। ধীরে ধীরে সে ফিসফিসিয়ে বলে, “আমার সন্তানটাকে তুমি দেখেছো?” অর্ণব কথা বলতে পারে না। হঠাৎ সে নারী মুখ তোলে—তার মুখের এক পাশ পুড়ে গেছে, চোখে নেই চোখের মনি, আর ঠোঁটে কেবল বিষণ্ণতা।

আর কিছু না ভেবে অর্ণব ছুটে পালিয়ে আসে, হাঁপাতে হাঁপাতে পৌঁছায় দাদুর বাড়িতে। দাদু তাকে পানি দিয়ে শান্ত করে, আর গ্রামের কয়েকজন বয়স্ক লোককে ডাকে। তারা এসে পুরো ঘটনা শোনে আর বলে, “তুই ভাগ্যবান যে ফিরে এসেছিস। সবাই ফিরতে পারে না।” তারা জানায়, বহু বছর ধরে যেই কেউ সেই কালো ঘরের কান্না শুনে ঘরের দিকে গেছে, তার কেউ আর ফিরে আসেনি। কেউ ভাবে তারা হারিয়ে গেছে, কেউ ভাবে—তারা হয়তো এখন সেই মায়ের সন্তান হয়ে গেছে।

অর্ণব এরপর আর কখনো সে ঘরের দিকে যায়নি। সে ভূতে বিশ্বাস করুক আর না-ই করুক, সেই রাতের অভিজ্ঞতা তার জীবনের সবচেয়ে ভয়ঙ্কর স্মৃতি হয়ে থেকে যায়। গ্রামের মানুষ আজও রাতে সেই ঘরের পাশ দিয়ে হেঁটে যায় না। কেউ যদি বলে, “আমি কান্নার শব্দ শুনেছি”—তবে সবাই জানে, তাকে এখন চোখে চোখ রাখতে নেই। কারণ সেই মা এখনো সন্তান খুঁজছে। আর যাকে একবার সে সন্তান ভেবে চিনে ফেলে, তাকে সে আর ফেরত দেয় না।

Post a Comment

0 Comments