বিলপাড়ার কবিরাজ
বিলপাড়া গ্রামের নাম শুনলেই মানুষের গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে। গ্রামের পাশে কালো জলের বিল আর ঘন জঙ্গলের মাঝে লুকিয়ে আছে এক অন্ধকার রহস্য। সেই রহস্যের কেন্দ্রে আছে বিলপাড়া কবিরাজ—একজন বৃদ্ধ, যার চোখে অদ্ভুত একটা আলো জ্বলে, গলায় ঝোলে অসংখ্য তাবিজ, আর হাতে থাকে পুরোনো মন্ত্রের বই। গ্রামের লোকেরা বলে, কবিরাজ শুধু ঝাড়ফুঁকই করে না, সে ভূত-প্রেতের সঙ্গে কথা বলতে পারে। কিন্তু এই ক্ষমতার পেছনে লুকিয়ে আছে এক ভয়ঙ্কর অভিশাপ।
এক অমাবস্যার রাতে, গ্রামের দুই যুবক, কাশেম আর সেলিম, বিলের ধারে মাছ ধরতে গিয়েছিল। রাত গভীর হতেই বিলের জলে একটা অদ্ভুত শব্দ শোনা গেল—যেন কেউ ফিসফিস করে কথা বলছে। সেলিম ভয় পেয়ে বলল, "কাশেম ভাই, এখানে কিছু একটা ঠিক নেই। চলো ফিরে যাই।" কিন্তু কাশেম হেসে বলল, "ভয় পাস কেন? এসব বাতাসের শব্দ।" কিন্তু তার কথা শেষ হতে না হতেই জলের মধ্যে থেকে একটা কালো ছায়া উঠে এল। সেই ছায়ার হাতে ছিল একটা পুরোনো তলোয়ার, আর তার চোখ দুটো জ্বলছিল সবুজ আগুনের মতো। সেলিম চিৎকার করে উঠল, আর কাশেম তাকে টেনে নিয়ে দৌড় দিল।
কিন্তু সেই ছায়া তাদের পিছু ছাড়ল না। গ্রামে পৌঁছে তারা সোজা বিলপাড়া কবিরাজের কাছে গেল। কবিরাজ তখন তার ঝুপড়ির সামনে বসে একটা আগুনের সামনে মন্ত্র পড়ছিল। তার গলায় ঝোলানো তাবিজগুলো অদ্ভুতভাবে কাঁপছিল। কাশেম কাঁপতে কাঁপতে সব বলল। কবিরাজ চুপ করে শুনে বলল, "তোমরা যাকে দেখেছ, সে কোনো সাধারণ ভূত নয়। সে বিলের প্রাচীন রক্ষক—কালো তলোয়ারের ভূত।"
কবিরাজ তখন তার অতীতের কথা বলতে শুরু করল। বহু বছর আগে, যখন সে তরুণ ছিল, তখন সে বিলের ধারে একটি প্রাচীন তলোয়ার পেয়েছিল। সেই তলোয়ারে খোদাই করা ছিল একটি মন্ত্র, যা দিয়ে ভূত-প্রেতকে নিয়ন্ত্রণ করা যায়। কিন্তু সেই মন্ত্র পড়ার পর থেকে তার জীবন অভিশপ্ত হয়ে গেল। কালো তলোয়ারের ভূত, যে বিলের অন্ধকারে বাস করে, তাকে শত্রু ভাবল। ভূতটি প্রতিশোধ নিতে চায়, আর যারা বিলের ধারে যায়, তাদের ওপর হামলা করে।
কবিরাজ বলল, "আমি বহুবার চেষ্টা করেছি তাকে বন্দি করতে, কিন্তু প্রতিবারই ব্যর্থ হয়েছি। আজ রাতে আমি শেষবারের মতো চেষ্টা করব।"
কবিরাজ কাশেম আর সেলিমকে নিয়ে বিলের ধারে গেল। তার হাতে ছিল একটি পুরোনো বই, যাতে লেখা ছিল প্রাচীন মন্ত্র। সে আগুন জ্বালিয়ে মন্ত্র পড়তে শুরু করল। হঠাৎ বাতাসে একটা ঝড় উঠল। গাছের পাতা ঝরে পড়তে লাগল, আর বিলের জল ফুটতে শুরু করল। কালো তলোয়ারের ভূত আবার দেখা দিল। এবার তার পুরো শরীরটা স্পষ্ট হয়ে উঠল—একটা কঙ্কালের মতো শরীর, যার হাতে জ্বলন্ত তলোয়ার, আর চোখ থেকে সবুজ আলো বেরোচ্ছে।
ভূতটি গর্জন করে বলল, "কবিরাজ, আজ তোর শেষ দিন!" কিন্তু কবিরাজ ভয় পেল না। সে তার তাবিজটা হাতে নিয়ে একটা শক্তিশালী মন্ত্র পড়তে শুরু করল। ভূতটি কবিরাজের দিকে এগিয়ে আসতে লাগল, কিন্তু মন্ত্রের শক্তিতে তার শরীর কাঁপতে শুরু করল। হঠাৎ কবিরাজের তাবিজ থেকে একটা সবুজ আলো বেরিয়ে ভূতটিকে আঘাত করল। ভূতটি চিৎকার করে জলে ডুবে গেল, আর বিলের জল শান্ত হয়ে গেল।
কবিরাজ ক্লান্ত হয়ে মাটিতে বসে পড়ল। সে বলল, "আমি জানি, সে আবার ফিরে আসবে। কিন্তু আপাতত গ্রাম নিরাপদ।" কাশেম আর সেলিম কবিরাজকে ধন্যবাদ দিয়ে বাড়ি ফিরল। কিন্তু সেই রাত থেকে বিলপাড়া গ্রামে আর কেউ বিলের ধারে যাওয়ার সাহস পায় না। কারণ সবাই জানে, কালো তলোয়ারের ভূত কখনো পুরোপুরি হারে না।
0 Comments