⛔ হাড়খেকো জিন ⛔


(একজন প্রত্যক্ষদর্শীর জবানিতে, পুরো ঘটনা  বর্ণনা)


আমার নাম হাকিম মিয়া। পৈত্রিকভাবে আমরা ছিলাম বাগেরহাটের দক্ষিণ-পশ্চিমে এক ঘন জঙ্গলে ঘেরা গ্রাম—নাম কাবিলপুর। এখন গ্রামটা আর খুঁজে পাওয়া যাবে না, মানচিত্রেও নাই। সরকার সেই জায়গা “বর্জিত এলাকা” বলে লাল দাগ দিয়ে রেখেছে। কিন্তু আমি জানি কেন রেখেছে। কারণ আমি ছিলাম সেই অভিশপ্ত রাতের একমাত্র জীবিত প্রত্যক্ষদর্শী।


ঘটনাটা শুরু হয়েছিল ১৯৯১ সালের নভেম্বরের শেষ সপ্তাহে। শীত জমে এসেছিল, জঙ্গল ঘন হয়ে উঠছিল, আর সন্ধ্যার পর থেকেই হঠাৎ বাতাসে একটা পচা, ধাতব গন্ধ ভেসে আসত। কেউ টের পেত না কোথা থেকে আসছে। গ্রামের উত্তর দিকে একটা পরিত্যক্ত কুটির ছিল, আগে এক তান্ত্রিক ভিক্ষু থাকত, বছর দশেক আগে আগুন লেগে ঘরটা পুড়ে যায়। সেই থেকেই জায়গাটা “মনাই” হয়ে পড়ে—কেউ যেত না।


একদিন সকালে দেখা গেল, সেই পোড়া কুটির থেকে কালো ধোঁয়া উঠছে। রফিক নামের এক ছেলেপিলে খবর দিল—“নতুন কেউ এসেছে।”


বড়রা প্রথমে পাত্তা দেয়নি। কিন্তু তার পরদিন থেকে যা ঘটতে লাগল, সেটা বর্ণনা করাও কঠিন।

প্রথমেই হারিয়ে গেল ফজলু মোল্লার গাভী। তারপর সালামত চাচার খাসি। পরের সপ্তাহে আমজাদ পাগলার হাঁসের খামার রাতারাতি খালি। কারও কিছু চোখে পড়ে না, কিচ্ছু শোনা যায় না। শুধু সকালে ঘাসে দেখা যায় টাটকা লাল রক্তের দাগ, আর মাঝে মাঝে এমন হাড়, যেন কেউ জিভ দিয়ে চেটে চেটে মাংস ছাড়িয়েছে।


আমি তখন যুবক, বয়স ৩১, শরীরে সাহস ছিল, বুকের ভিতর ছিল কৌতূহল। আমি নিজেই গেলাম কুটিরটা দেখতে।


দূর থেকেই কেমন একটা শ্বাসকষ্ট অনুভব হল, শরীরে কাঁটা দিয়ে উঠল। ভেতরে ঢুকে দেখি—একজন মাঝবয়সী পুরুষ বসে আছে, পাথরের মূর্তির মতো, চোখ কোটরের ভিতর গর্ত, আর ঠোঁটজোড়া পুড়ে গেছে মনে হল। সে কিছু বলল না, শুধু আমার দিকে তাকিয়ে ছিল একভাবে—যেন বহুদিন ধরে আমার শরীরের ভিতর কী আছে, সেটা বোঝার চেষ্টা করছিল।


তার চারপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল হাড়—না, শুধু হাড় না, মানুষের দাঁতও। ছোট ছোট বোতলে লাল কিছু তরল। দেয়ালে লেখা, “মাংসের চেয়ে পবিত্র কিছু নেই।”


সেদিন রাতেই শুরু হল জাহান্নামের দ্বার খুলে যাওয়ার মত এক আতঙ্ক।


গ্রামে একে একে মানুষ হারাতে লাগল—প্রথমে জাহিদ, তারপর রুকাইয়া, তারপর হাসান মাস্টারের মেয়ে রিমি। তাদের কোনো দেহ পাওয়া যায়নি। শুধু শরীরের হাড়—কিন্তু এত পরিষ্কার, যেন ধারালো ছুরি নয়, বরং কেউ দাঁত দিয়ে গিলে গিলে কেটেছে। মাংস নেই, রক্ত নেই, কেবল হাড়।


তখন আমরা গ্রামের কয়েকজন মিলে সিদ্ধান্ত নিলাম—আর সহ্য করা যাচ্ছে না। আমি, কাশেম ডাক্তার, রবিউল আর মুন্না—চারজন মিলে এক রাতে কুটিরে গেলাম।


ঘরের দরজায় তালা নেই, কিন্তু দরজাটা ঠেলে খোলা যায় না। যেন ভেতর থেকে কেউ ধরেই রেখেছে। কাশেম বলল, “আউযুবিল্লাহ... কিছু একটা আছে।” এরপর আমি আলতো করে জানালায় তাকালাম—ঘরের ভেতরে যে বসে আছে, সেটা মানুষ না।


তার শরীরের গঠন মানুষের মতো হলেও, হাতগুলো ছিল অনেক লম্বা—হাতের আঙুল ৮টা, আর আঙুলের মাথায় ধারাল নখ, যেমন জংধরা ছুরিতে থাকে। সে হঠাৎ ঘাড় ঘুরিয়ে আমাদের দিকে তাকাল। কিন্তু তার চোখে কোনো মানুষী দৃষ্টি নেই—একটা খালি গর্ত, যেন কেউ চোখ তুলে নিয়েছে।


রবিউল ভয় পেয়ে দৌড় দেয়। তারপর?

সে আর জীবিত ফেরেনি।


পরদিন সকালে তার শরীর পাওয়া গেল গাবগাছের নিচে। শরীরের অর্ধেক ছিল না। বুকের মাঝখানটা ফাঁকা, ভেতরের সবকিছু যেন কেউ চুষে খেয়ে নিয়েছে। শরীরের পাশে লেখা ছিল:

"আমার ক্ষুধা থামে না, যতক্ষণ না বিশ্বাস নষ্ট হয়।"


তারপর আমি বুঝতে পারলাম, নাসিম নামে যে লোকটা কুটিরে থাকে—সে মানুষ না। সে একটা কাফের জিন। এবং সে যে ধ্বংস ছড়াচ্ছে, সেটা কোনো অভিশাপ না—একটা পরিকল্পিত শিকার।


কাফের জিনরা নাকি মানুষের বিশ্বাস ভাঙার জন্য জন্ম নেয়। তারা থাকে শ্মশান, জঙ্গল, আর ভাঙা ঘরে। তারা মুসলমানের কণ্ঠে আজান সহ্য করতে পারে না, কিন্তু কেউ যখন নামাজ ছাড়ে, তখন সে হয়ে পড়ে শিকার।


আমরা যখন গ্রামের মানুষদের নিয়ে হুজুরের কাছে যাই, তিনি বলেন, “নাসিম যে পথ বেছে নিয়েছে, সেটা নিষিদ্ধ জাদুর পথ। সে নিজের আত্মা বিক্রি করে খোলা রেখেছে দরজা—এমন এক দরজা, যেটা একবার খুললে মানুষ নয়, পুরা গ্রাম ধ্বংস হয়ে যায়।”


আর সেটাই হল।


সেই রাত—১৪ই ডিসেম্বর, ১৯৯১। আমরা সবাই বুঝেছিলাম কিছু ঘটবে। কিন্তু কেউ প্রস্তুত ছিল না।


রাত ১২টা। গ্রামের মাঝখানে হঠাৎ একটা বিশাল গর্জন—মাটির নিচ থেকে যেন কিছু বেরিয়ে এল। কুটির থেকে আগুনের মতো ধোঁয়া উঠছে, ভেতর থেকে ভেসে আসছে একসাথে শতকণ্ঠের কর্কশ আওয়াজ—“আরও দাও... আরও মাংস দাও…”


তারপর আমরা দেখি, পুরো কুটিরটা ভেঙে যাচ্ছে না, বরং ধীরে ধীরে মাটির ভিতর ঢুকে যাচ্ছে, যেভাবে জ্যান্ত কিছু গিলে নেয় মাংস।


আমরা যারা বেঁচে ছিলাম, পালালাম। কেউ পেছন ফিরে দেখেনি। শুধু সকালে কুয়াশার ভেতর কেউ একজন দেখেছিল—নাসিম দাঁড়িয়ে, তার মুখে মানুষের হাড় কামড়ানো, চোখে বিজলি জ্বলছে।


আমি এরপর পালিয়ে যাই। ৩২ বছর হয়ে গেছে।


কিন্তু জানেন? গত সপ্তাহে আমার নাতি লালচে একটা কলস কুড়িয়ে এনেছে খেলার ছলে। আমি যখন কলসটা দেখি, শিরদাঁড়া দিয়ে ঠান্ডা নেমে যায়। সেটা সেই কলস—যেটার ভেতর “তাকে” ডাকা হত। আমি সেটা আগুনে পুড়িয়ে ফেলি। কিন্তু আগুন নেভে না। পানি দিই, শুকায় না। কুড়িয়ে আনা কলসটা এখনো আমার ঘরের এক কোণায় বসে আছে, আর মাঝে মাঝে আমি রাতে শুনি—


“আরও দাও।”


---


বিশেষ দ্রষ্টব্য - লেখায় ভুল ত্রুটি অবশ্যই ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন....

Post a Comment

0 Comments