⛔বৃষ্টি ভেজা সন্ধ্যা⛔
বৃষ্টিভেজা পাহাড়ি পথ ধরে হাঁটছিল রেহান। রাত নামতে শুরু করেছে, আর বৃষ্টিও যেন ক্রমশ আগ্রাসী হয়ে উঠছে। অফিস থেকে ফেরার সময় মাঝপথে তার বাইক বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। কয়েকবার চালানোর চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়ে বাধ্য হয়েই হাঁটা ধরেছে। জায়গাটা ভয়ঙ্কর নির্জন—চারদিকে ঘন জঙ্গল আর আঁকাবাঁকা পথ, যেখানে দিনের আলো পর্যন্ত ঠিকমতো পৌঁছায় না।
প্রথমদিকে ব্যাপারটাকে স্বাভাবিক মনে হলেও ধীরে ধীরে রেহানের মনে অস্বস্তি চেপে ধরল। কোথাও কোনো জনমানবের চিহ্ন নেই, অথচ তার মনে হচ্ছে কেউ তাকে অনুসরণ করছে!
কিছুক্ষণ পর স্পষ্টই টের পেল—পায়ের নিচে কাদা থাকলেও তার নিজের পায়ের আওয়াজের পাশাপাশি আরও একটি শব্দ ভেসে আসছে। যেন তার পেছনেই কেউ হাঁটছে!সে দ্রুত ঘুরে তাকাল।কেউ নেই!
শুধু বাতাসে দুলতে থাকা গাছের ছায়া, বৃষ্টির শব্দ, আর দূর থেকে ভেসে আসা ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক। কিন্তু তার কাঁধের পেছনে তখনও একটা অদৃশ্য শীতল স্পর্শ অনুভব করল সে।
হঠাৎ করেই ঝিরঝিরে বাতাসের সঙ্গে মিলেমিশে একটা চাপা গুঞ্জন ভেসে এল, যেন অনেকগুলো গলা ফিসফিস করে কিছু বলছে—
"ফিরে যা... থামো... যেও না..."
রেহানের গা শিউরে উঠল।সে মনে করল, হয়তো বাতাসের সঙ্গে পাতার শব্দের ভুল বোঝাবুঝি হচ্ছে। কিন্তু কিছু একটা ঠিক নেই! গলার স্বরগুলো যেন একবার দূর থেকে, আবার একবার খুব কাছ থেকে ভেসে আসছে!পাঁচ মিনিট পরেই রাস্তার মোড় ঘুরতেই তার চোখ থমকে গেল।
সামনের রাস্তার মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে একটা মেয়ে!লাল শাড়ি, এলোমেলো চুল, পানির মতো ফ্যাকাসে ত্বক, আর অস্বাভাবিক জ্বলজ্বল করা চোখ!
তার পা অবশ হয়ে গেল। মেয়েটা একদম নড়ছে না, শুধু স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তার দিকে।রেহান ধীরে ধীরে মেয়েটার দিকে এগোল, গলা শুকিয়ে এসেছে।
"কে... আপনি এখানে কী করছেন?"
মেয়েটা কথা বলল না, শুধু ঠায় দাঁড়িয়ে রইল। বৃষ্টির ফোঁটাগুলো যখন তার শরীরে পড়ছে, তখন মনে হলো যেন শরীরটা আস্তে আস্তে মিলিয়ে যাচ্ছে বৃষ্টির সঙ্গে!
হঠাৎ একটা বিদ্যুতের ঝলকানি পড়ল, আর সেই আলোয় রেহান যা দেখল, তার ভেতরের সব রক্ত যেন জমে গেল!মেয়েটার গালজুড়ে গভীর নীলচে দাগ, গলায় কাটা দাগ!
তার চোখে যন্ত্রণার ছাপ, অথচ ঠোঁটের কোণে হালকা একটা বিভীষিকাময় হাসি!রেহান আতঙ্কে কয়েক কদম পিছিয়ে গেল।এবার মেয়েটা আস্তে আস্তে ফিসফিস করে বলল—
"আমাকে... বাঁচাও..."
কিন্তু গলার স্বরটা যেন মেয়েটার মুখ থেকে আসছে না!এটা আসছে চারপাশের গাছের ফাঁক থেকে, ঝোপের আড়াল থেকে, বাতাসের মধ্য দিয়ে—যেন চারপাশ থেকে অসংখ্য মৃত আত্মা একই কথা বলছে!
মেয়েটা এবার ধীরে ধীরে তার দিকে এগোতে লাগল।রেহান এবার বুঝতে পারল, তার ছায়া নেই!
সে দৌড়াতে চাইল, কিন্তু তার শরীরের শক্তি যেন হারিয়ে গেছে! মনে হলো, পেছন থেকে কেউ তাকে শক্ত করে ধরে রেখেছে!পাশের ঝোপ থেকে বেরিয়ে এল আরও কয়েকটা হাত!শুষ্ক, বিবর্ণ, কঙ্কালের মতো হাত!
তারা রেহানের পায়ের গোড়ালি চেপে ধরল। কাদার মধ্যে থেকে টেনে নামানোর চেষ্টা করল!রেহান চিৎকার করতে চাইল, কিন্তু গলা দিয়ে কোনো শব্দ বের হলো না।
এবার মেয়েটা একেবারে সামনে এসে দাঁড়াল। তার চোখ থেকে গলগল করে রক্ত পড়ছে!তার মুখ আস্তে আস্তে খুলছে... কিন্তু ভেতরে কোনো জিহ্বা নেই, দাঁত নেই...
ভেতর থেকে বেরিয়ে এলো আরও একটা হাত!একটা বিকৃত, হাড় জিরজিরে হাত, যে হাতটা রেহানের গলা চেপে ধরল!
ঠিক তখনই বাজ পড়ল!বিদ্যুতের আলোয় কয়েক সেকেন্ডের জন্য পুরো জঙ্গল আলোকিত হয়ে উঠল।আর সেই আলো কেটে যেতেই...সবকিছু হঠাৎ নিস্তব্ধ হয়ে গেল।
পরদিন সকালে...
পাহাড়ি গ্রামের কয়েকজন লোক রাস্তার পাশের খাদে রেহানের নিথর দেহ খুঁজে পেল।তার শরীরে একটিও আঘাতের চিহ্ন নেই।
শুধু তার চোখদুটো খোলা ছিল, আর তার মুখের ভেতর ঢোকানো ছিল একটা শুকনো, বিবর্ণ, মাটির রঙের হাত.আর রাস্তার ধারে ভেজা মাটিতে তখনও একটা অস্পষ্ট পায়ের ছাপ দেখা যাচ্ছিল।
সেই ছাপগুলো হঠাৎ করেই রাস্তার মাঝখানে এসে অদৃশ্য হয়ে গেছে...
0 Comments