Pukur Parer Oshoriri

পুকুরপাড়ের অশরীরী⛔⭕

সাতগাঁ গ্রামের পাশেই বিশাল এক পুরনো পুকুর। গাঁয়ের মানুষ বলে, এই পুকুরে অদ্ভুত সব ঘটনা ঘটে। বিশেষ করে দুপুরবেলা, যখন সূর্যের আলো কড়া আর চারপাশ নিস্তব্ধ। কেউ বলে, এখানে এক জিনের বাস। পুরনো আমলের এক অভিশপ্ত আত্মা, যে তার জায়গা ছাড়তে চায় না।

সে দিনটা ছিল চৈত্র মাসের এক ভরদুপুর। গ্রামের কিশোর বায়েজিদ তার বাবা কালাম মিয়ার সাথে পুকুর থেকে মাছ ধরতে গিয়েছিল। মাছ ধরা শেষে বায়েজিদ একাই এগিয়ে যাচ্ছিল পুকুরপাড় ধরে। তার হাতে ছিল একটা বড় বোয়াল মাছ, যা সে বাড়ির দিকে নিয়ে যাচ্ছিল। কিন্তু হঠাৎই সবকিছু যেন পাল্টে গেল।

বায়েজিদ থমকে দাঁড়াল। বাতাস বন্ধ হয়ে এল, চারপাশের পাখির ডাক থেমে গেল। মনে হলো, কেউ বা কিছু তার আশেপাশে নিঃশব্দে ঘুরে বেড়াচ্ছে।"কে?"— সে ধীরে ধীরে ফিসফিস করে বলল।

কিন্তু কোনো উত্তর এল না। বরং হঠাৎ করেই তার শরীরের ভেতর ঠান্ডা একটা স্রোত বয়ে গেল, যেন কেউ তার শিরদাঁড়া বরাবর বরফের মতো হাত বুলিয়ে দিল।

তার চোখ কুঁচকে এল। একটা অদৃশ্য শক্তি যেন তাকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে পুকুরের গভীর অন্ধকারের দিকে। সে চিৎকার করতে চাইল, কিন্তু গলা দিয়ে কোনো আওয়াজ বের হলো না। তার চোখ বড় হয়ে গেল, মুখ হাঁ হয়ে রইল, আর শরীর শক্ত হয়ে গেল, যেন সে এক মরদেহ।

পুকুরপাড়ের কিছু লোক তখনও আশেপাশে ছিল। তারা হঠাৎই বায়েজিদের অস্বাভাবিক আচরণ লক্ষ্য করল। সে একদম নিথর দাঁড়িয়ে, তার চোখদুটো লালচে হয়ে গেছে, ঠোঁট ফাঁক হয়ে আছে, আর শরীরের ভঙ্গি অদ্ভুত।"ওরে, এ যে জিনের আসর!"— এক বৃদ্ধ চিৎকার করে উঠলেন।

বায়েজিদের বাবা কালাম মিয়া দৌড়ে এলেন, ছেলেকে ধরে টান দিলেন। কিন্তু বায়েজিদ তখন আর স্বাভাবিক নেই। তার শক্তি যেন কয়েকগুণ বেড়ে গেছে। সে হিংস্র চোখে তাকিয়ে আছে, মুখ দিয়ে ফিসফিস শব্দ করছে, যেন কোনো অচেনা ভাষায় কথা বলছে।"এরে কবিরাজের কাছে নিতে হবে, নয়তো এক্ষুনি শেষ!"— গ্রামের এক অভিজ্ঞ লোক বলল।

বায়েজিদকে ধরে নিয়ে যাওয়া হলো গ্রামের বিখ্যাত ওঝা হাশেম কবিরাজের কাছে। হাশেম কবিরাজ প্রথম দেখাতেই বুঝতে পারলেন, বিষয়টা ভয়ংকর।

সে পুঁথি খুলে কিছু মন্ত্র পাঠ করতে লাগল। বায়েজিদের শরীর হঠাৎ কেঁপে উঠল। তার মুখ দিয়ে বিকট এক আওয়াজ বের হলো, যেন একসাথে অনেকগুলো মানুষের কণ্ঠ এক হয়ে গর্জে উঠেছে।"এ জায়গা আমাদের! চলে যাও!"— সেই কণ্ঠ বলে উঠল।

কবিরাজ বোঝালেন, এই পুকুর একসময় এক পরিত্যক্ত জায়গা ছিল। বহু বছর আগে এখানে এক সাধু ধ্যান করত। কেউ বলে, সে ছিল জাদুকর। তার মৃত্যুর পর তার আত্মা এখানেই রয়ে গেছে, আর এখন সে কিছু কিছু মানুষের ওপর ভর করে।

হাশেম কবিরাজ একে একে কয়েকটি আয়াত পড়তে লাগলেন। পানির মধ্যে একদলা লবণ ছুড়ে দিলেন।বায়েজিদ এবার কাঁপতে লাগল, তার শরীর শক্ত হয়ে এল, তারপর এক প্রচণ্ড ঝাঁকুনি দিয়ে সে নিস্তেজ হয়ে গেল।চারদিক নিস্তব্ধ। বাতাস যেন আবার বইতে শুরু করল, গাছের পাতা মৃদু নড়ল।

বায়েজিদ সুস্থ হলেও সে আর আগের মতো রইল না। মাঝে মাঝে গভীর রাতে সে হঠাৎ চমকে উঠে বসে। কখনো ফিসফিস করে বলে, "ওরা এখনো আমাকে খোঁজে…"

গ্রামের মানুষ তখন থেকে আর দুপুরবেলায় পুকুরের কাছে যায় না। তারা বিশ্বাস করে, পুকুরের গভীরে আজও কেউ বা কিছু অপেক্ষায় আছে— হয়তো আরেকজনকে নিজের করে নেওয়ার জন্য!

Follow for more

Post a Comment

0 Comments