প্রেতাত্মা । ভূতের গল্প

 

Pret Atta

প্রেতাত্মা

সকাল দশটা নাগাদ পাণ্ডুয়া এসে পৌঁছেছি বাল্যবন্ধু অতুল রায়ের বাড়িতে। বেশ কয়েকটা বছর দু'জনের কোনও যোগাযোগ ছিল না কিন্ত কাল বিকালে হঠাৎ করেই অতুলের ফোন পেলাম। স্কুলে গ্রীষ্মের ছুটি চলছে বলে তেমন কোনও কাজের চাপ নেই। তাই অতুলের প্রস্তাবে কোনও আপত্তি না জানিয়ে চলে এলাম। এখানে পৌঁছে দেখি আমার কলেজের আর এক বন্ধু সঞ্জুও আমন্ত্রিত। তিনবন্ধুতে অনেক ঘোরাঘুরি হলো, এখানে ঘুরে দেখার মতন অনেক কিছু আছে। সন্ধ্যার কিছু আগে আমরা মহিমগড় রাজবাড়ীর সিঁড়ির সামনে এসে হাজির হলাম। বিশ-তিরিশটা সিঁড়ি ভেঙে রাজবাড়ির চৌকাঠে পা রাখতেই গার্ড ভোম্বল সেন আমাদের সাথে সাথে যেতে লাগল। তার মুখ থেকেই শুনলাম এই রাজবাড়ি নিয়ে কিছু অবিশ্বাস্য কাহিনী। সিংহ বংশীয় এক রাজা বিজয়প্রতাপ মারা গেছেন প্রায় একশো বছর আগে কিন্তু জনশ্রুতি যে আজও নাকি তার আত্মা এই বাড়ির আনাচে কানাচে ঘুরে বেড়ায়। আমি গার্ডকে জিজ্ঞাসা করলাম- "আচ্ছা, রাজ পরিবারের কেউ এখানে থাকে না?"

গার্ড- "আর পরিবার! আজ যে এই রাজবংশের কেউ বেঁচে নেই। দূর সম্পর্কের যারা আছে, তারাও এখানে আসতে সাহস পায় না।"

আমি- "সাহস পায় না মানে?"

গার্ড- "ঐ যে বললাম রাজার প্রেতাত্মা। বিজয়প্রতাপের মৃত্যুর পরই শুরু হয় এই বংশের বিপর্যয়। রাজার একমাত্র ছেলে অজয়প্রতাপ ছিলেন যাকে বলে নষ্ট পুরুষ। মদ আর মেয়ে মানুষ নিয়ে বিভোর হয়ে থাকতেন আর ওদিকে বন্ধুরা মজা লুটত। রাজকোষ দিনদিন শূন্য হতে থাকে, রাজবাড়িটা একটা নোংরামির ঘাঁটিতে পরিণত হল। বাজারে অনেক বদনামও করে ফেলল অজয়প্রতাপ। অবশেষে হঠাৎই একদিন তিনি খুন হলেন। খুনী ধরা পড়েনি বটে তবে লোকে বলে সিংহ বংশের অবশিষ্ট সম্মানটুকু বজায় রাখার জন্য বিজয়প্রতাপের আত্মাই নাকি তার ছেলেকে শেষ করেছে।"

আমি হেসে মন্তব্য করলাম- "রাজার প্রেতাত্মা! ওসব কিছু নয়। সম্পত্তি গ্রাসের লোভে বন্ধুরাই কেউ মেরে ফেলেছে বিকার গ্রস্ত বিজয়প্রতাপকে।"

আমার কথা শুনে গার্ড কেমন এক ব্যঙ্গহাসি হাসলো। এদিক ওদিক ঘুরে রাত নটা নাগাদ আমরা অতুলের বাড়ি ফিরে খাওয়া দাওয়া সেরে ঘুমাতে গেলাম। আমার আর সঞ্জুর শোয়ার ব্যবস্থা হয়েছে একই ঘরে। রাতে সঞ্জু আমাকে একটা মোটা সোনার হার বের করে দেখাল। আমি চিনতে পারলাম, এটা তো রাজা বিজয়প্রতাপের মূর্তিটার গলায় দেখা সেই চেনটা। আমি চিৎকার করে বলে উঠলাম- "এই সঞ্জু! এটা তুই রাজবাড়ী থেকে চুরি করে এনেছিস?"

সঞ্জু- "হ্যাঁ...তো কি হয়েছে? মরা মূর্তিটার গলায় বেকার পরে ছিল, তাই ঝেড়ে দিলাম। এটা এবার আমার গলায় ঝুলবে।"

আমি- "দেখ ভাই, আমার কিন্তু খুব ভয় করছে। বিজয় প্রতাপের আত্মার ব্যাপারটা যদি সত্যি হয়, তাহলে কপালে...."

সঞ্জু- "ধুর, বাদ দে তো। যত্তসব ছেলেভোলানো গল্প...।"

আমি- "তা হোক গে, চুরি করাটা তো অন্যায়। কাল আমরা দু'জন রাজবাড়িতে আবার যাব। তুই চুপিচুপি যেথাকার জিনিস সেখানেই রেখে আসবি, ওকে..."

সঞ্জু- "আরে...কালকের চিন্তা কাল হবে, এখন ঘুমা তো। এত দামি একটা চেন ফালতু ফালতু হাতছাড়া করব। পাগল নাকি....!"

সকালে বাইরে থেকে অতুলের হাঁকডাক শুনে ঘুম ভাঙতেই দেখি আমি বিছানার পাশে মেঝেতে শুয়ে আছি। ধড়ফড় করে উঠে পড়ে আমি হতবাক হয়ে গেলাম, সঞ্জু ঘরে নেই। মনে পড়ল রাতের স্বপ্নটার কথা। একটা বৃহৎ কালো বাদুড় জানালা দিয়ে ঢুকে হার ঝোলানো সঞ্জুর গলা কামড়ে ধরল আর আমি ভয়ে বিছানা থেকে গড়িয়ে পড়লাম। তবে কি এ স্বপ্ন নয় কিন্তু বন্ধ ঘর থেকে সঞ্জু গেল কোথায়? তবে কি প্রেত বাদুড়টাই কাল রাতে তাকে নিয়ে গেছে?

অতুল আশপাশে অনেক খোঁজাখুঁজি করেও সঞ্জুর খোঁজ পেলো না। আমিও সঞ্জুর চেন চুরি আর রাতে দেখা স্বপ্নটার কথা এড়িয়ে গেলাম। রহস্যটা কাটিয়ে তোলার জন্য আমি অবশেষে সঞ্জুর মোবাইলে কল করলাম। কয়েকবার রিং হওয়ার পর অবশেষে ফোনটা রিসিভ করা হলো। আমি ভুল পরিচয় দিয়ে বললাম- "হ্যালো সঞ্জু, আমি তীর্থঙ্কর বলছি রে। চিনতে পারছিস? আরে হাওড়ার তীর্থঙ্কর। তোর বন্ধু।"

কান্নাভেজা গলায় উত্তর এলো- "আমি সঞ্জু নই, ওর বাবা বলছি। সঞ্জু আর এই দুনিয়াতে নেই...।"

আমি- "নেই মানে! কি হলো ওর?"

সঞ্জুর বাবা- "জানি না বাবা। কাল সকালে পাণ্ডুয়া গেছিল বন্ধুর বাড়ি। রাত প্রায় তিনটেয় বাড়ি ফিরে ঘুমোতে গিয়েছিল। আর ওঠে নি। অনেক ডাকাডাকি করে সাড়া না পেয়ে দরজা ভেঙে দেখি এই অবস্থা।"

আমি বললাম- "সেকি! অদ্ভুত ব্যাপার। ডাক্তার ডাকেননি? ডাক্তারবাবু কি বললেন?"

ফোনের ওপাশ থেকে আসা উত্তরটা শুনে আমার কাছে সব জলের মতন পরিষ্কার হয়ে গেল আর ভয়ে সারা শরীর ঝাকুনি দিয়ে উঠল। সঞ্জুর বাবা কান্নায় ফেটে পড়ে বললেন- "ডাক্তার বাবু এসেছিলেন। উনি বললেন কোনও এক বীভৎস ভয়ে নাকি সঞ্জুর হার্ট অ্যাট্যাক হয়েছে।"

অতুলের বাড়িতে আর থাকতে মন করছিল না। এই বীভৎস অভিজ্ঞতার শিকার হয়ে আমার হৃৎস্পন্দন বহুগুণ বেড়ে গেছে। ব্যাগপত্র গুছিয়ে দশটা নাগাদ অতুলের বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়লাম। পথে পড়ল সেই রাজপ্রাসাদ, একবার ভেতর থেকে ঘুরে আসতে মন চাইল বলে প্রাসাদে ঢুকে পড়লাম আর সেখানে গিয়েই আরও একবার উন্মত্তের মত শিউরে উঠলাম। দেখলাম বিজয়প্রতাপের সেই মূর্তিটার গলায় ঝুলছে সঞ্জুর চুরি করা দামি চকচকে সেই সোনার চেনটা।

সমাপ্ত,,,


Follow for more

Post a Comment

0 Comments