অতীতের ছায়া
নয়নচাঁদপুর, রাজশাহীর প্রান্তে অবস্থিত একটি প্রাচীন গ্রাম, যেখানে সময় থেমে আছে বলে মনে হয়। চারদিকে ঘন জঙ্গল, মাঝখানে পড়ে থাকা ধানক্ষেত আর গ্রামের প্রান্তে এক পুরোনো জমিদার বাড়ি—যা আজ ধ্বংসস্তূপে পরিণত। জায়গাটি এতটাই ভয়ংকর আর রহস্যময় যে সন্ধ্যা নামলেই মানুষ আর সেখানে যেত না। শোনা যায়, রাত ১২টার পর সেই জমিদার বাড়ি থেকে কান্নার আওয়াজ আসে, কেউ কেউ বলে সাদা শাড়ি পরা এক নারী ছাদের কিনারে দাঁড়িয়ে থাকে।
এইসব গল্প শুনে একদিন শহর থেকে আসে রিদম নামের এক তরুণ ইতিহাস গবেষক। সে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র, গবেষণা করছে বাংলার পুরনো জমিদার বাড়ির ইতিহাস নিয়ে। ভূতে তার বিশ্বাস নেই, তাই সে ভাবে এসব শুধু লোককথা। কিন্তু স্থানীয় মানুষরা খুব ভীত। হরিধন কাকা নামে এক বৃদ্ধ তাকে সাবধান করে দেন, “বাবা, ইতিহাস ভালো, কিন্তু অতীতের কিছু জিনিস অতীতেই থাকুক ভালো।”
তবুও, রিদম সাহস করে ঠিক করে, সে একরাত জমিদার বাড়িতে কাটাবে। টর্চ, ক্যামেরা আর মোবাইল নিয়ে সে সন্ধ্যায় বাড়িতে ঢুকে পড়ে। বাড়ির ভেতর অন্ধকার, চারপাশে শ্যাওলা জমা, জানালা দিয়ে বাতাস ঢুকে ঠকঠক শব্দ করছে। রাত বাড়ে, আর বাড়ির পরিবেশ বদলাতে থাকে। ঠিক রাত ১২টার সময় হঠাৎ বাতাসের গতি বেড়ে যায়, রিদমের টর্চ ঝিমঝিম করতে থাকে। তখন সে দেখতে পায়—দূরে সিঁড়ির কাছে দাঁড়িয়ে আছে সাদা শাড়ি পরা এক নারী। তার মুখ দেখা যাচ্ছে না, কিন্তু ধীরে ধীরে সে বলে ওঠে, “তুমি ফিরে এসেছো? আমি কতো বছর অপেক্ষা করেছি জানো?” রিদম ভয় পেলেও জিজ্ঞাসা করে, “আপনি কে? কী চান?”
নারীটি মুখ তোলে—দেখা যায়, তার চোখ নেই, শুধু ফাঁকা কালো গহ্বর, আর মুখে বিষাদ। সে আবার বলে, “তুমি তো প্রতিজ্ঞা করেছিলে ফিরে আসবে… কেন দেরি করলে?” রিদম দৌড়াতে চায়, কিন্তু পা যেন জমে গেছে। সে পড়ে যায়, অজ্ঞান হয়ে পড়ে যায় উঠোনে।
পরদিন সকালে গ্রামের লোকেরা দেখে, রিদম জমিদার বাড়ির সামনের উঠোনে পড়ে আছে। তারা তাকে উদ্ধার করে হরিধন কাকার বাড়িতে নিয়ে আসে। দীর্ঘ সময় পর সে জ্ঞান ফিরে পায় এবং যা বলল, তাতে সকলে স্তব্ধ হয়ে যায়। রিদম বলে, “আমি ওকে দেখেছি। ওর নাম ছিল রূপসী। জমিদারের মেয়ে। সে এক চাকরের প্রেমে পড়েছিল, কিন্তু প্রেমের খবর জানার পর জমিদার সেই ছেলেটিকে খুন করে। আর রূপসী সেই রাতে ছাদ থেকে ঝাঁপ দেয়। সেই রাতটাই ছিল বারোই চৈত্র, আর আমি গিয়েছিলাম ঠিক সেই রাতেই।”
লোকজন অবাক হয়ে যায়—এসব তথ্য রিদম জানল কীভাবে? সে বলে, “ও আমাকে দেখিয়েছে। ওর চোখ দিয়ে আমি অতীত দেখেছি। ও এখনো অপেক্ষা করছে। ও চায় কেউ ফিরে আসুক, প্রতিজ্ঞা পূরণ করুক। হয়তো আমি এখনো পুরোপুরি ফিরিনি...”
এই ঘটনার পর থেকে রিদম বদলে গেছে। সে আয়নার দিকে তাকায় না, রাতে জানালার পাশে দাঁড়ায় না, আর কারও ডাকে সহজে সাড়া দেয় না। গ্রামবাসীরা বলে, তার চোখে মাঝে মাঝে রূপসীর ছায়া দেখা যায়। কেউ কেউ বিশ্বাস করে, অতীতের কোনো ছায়া হয়তো এখনো তার সঙ্গে রয়ে গেছে।
কারণ, একবার যে অতীতের ছায়ায় ঢুকে পড়ে—সে আর কোনোদিন পুরোপুরি ফিরে আসে না।
0 Comments