চিঠিটার শেষ লাইন
সেপ্টেম্বর মাসের এক সন্ধ্যায়, হালকা বৃষ্টি পড়ছে। আকাশজুড়ে কালো মেঘ, মাঝে মাঝে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে, আর চারপাশে একটা অজানা নীরবতা। এইরকম এক সন্ধ্যায় অরিত্র শহর থেকে আসে তার দাদুর পুরনো বাড়িতে—যেটা আজ প্রায় পঁচিশ বছর ধরে ফাঁকা পড়ে আছে। ছোটবেলায় অনেকবার এসেছিল এখানে, কিন্তু দাদুর মৃত্যুর পর কেউ আর আসেনি। এবার এসেছে নিজেকে একটু গুছিয়ে নেওয়ার জন্য—মানসিকভাবে ক্লান্ত, একা, আর কেমন একটা ব্যাখ্যাতীত টান অনুভব করছিল এই বাড়িটার প্রতি।
বাড়িটা এখন প্রায় ধ্বংসস্তুপে পরিণত হয়েছে। দরজা খুলতেই ধুলো, শ্যাওলা আর ঘুনপোকায় খাওয়া কাঠের গন্ধ নাকে এল। তবুও ঘরের ভিতরে ঢুকে সে যেন একটা আশ্চর্য শান্তি অনুভব করল। সব আসবাবপত্র জায়গায় আছে, যেন কেউ দিনের পর দিন ধরে ওগুলো ঠিকঠাক রেখেছে। হঠাৎ চোখ পড়ে গেল একটা টেবিলের উপর। ধুলোয় ঢাকা সব কিছু, কিন্তু একটা জায়গা একেবারে পরিষ্কার। সেখানে রাখা একটি খাম, তাতে মোটা অক্ষরে লেখা—"অরিত্র"।
অরিত্র বিস্মিত। এই নাম লেখা খাম এখানে কীভাবে এলো? হাত কাঁপতে কাঁপতে খামটা খুলল সে। ভিতরে একটি চিঠি। কাগজটা পুরনো, হলুদ রঙের, কিন্তু অক্ষরগুলো একেবারে স্পষ্ট:
"যখন তুমি এই চিঠি পড়বে, আমি হয়তো আর থাকবো না। কিন্তু জানবে, আমি তোমার জন্য অপেক্ষা করেছিলাম অনেক বছর... শুধু একটা শেষ কথা বলার জন্য। ফিরে এসো, অরিত্র। আমি এখনও এই ঘরের মাঝে আছি। তোমার জন্য।"
হঠাৎ যেন ঘরের বাতাস ভারি হয়ে উঠল। দরজাটা ধীরে ধীরে বন্ধ হয়ে গেল, জানালা ঝাঁপ করে আটকে গেল। বাতি এক এক করে নিভে গেল। অরিত্রর মনে হলো, কেউ যেন ঠিক তার পেছনে দাঁড়িয়ে আছে। ধীরে ধীরে সে ঘুরে দাঁড়াল—আর তখনই দেখতে পেল, ঘরের এক কোণায় একটা ছায়ামূর্তি দাঁড়িয়ে আছে। সাদা পোশাকে, মাথা নিচু, চোখদুটো আগুনের মতো লাল। তার মুখ স্পষ্ট নয়, কিন্তু সেই কণ্ঠস্বর... অরিত্রর ছোটবেলার মতন, একেবারে এক রকম।
“তুমি বলেছিলে তুমি ফিরে আসবে, অরিত্র। কিন্তু তুমিও তো কথা রাখোনি। আমি আজও অপেক্ষা করি। প্রতিদিন এই বাড়ির ঘড়ির কাঁটার মতো সময় গুনে গুনে বসে থাকি… আর তুমি এসেছো, এত দেরিতে।”
ভয়ে গলা শুকিয়ে গেছে অরিত্রর। দৌড়ে দরজার দিকে ছুটল সে, কিন্তু দরজা একটুও খুলছে না। তখন ছায়ামূর্তিটা ধীরে ধীরে এগিয়ে আসে। চারপাশে শীতল হাওয়া, বাতাস থেমে গেছে। দেয়ালের ঘড়ি থেমে আছে ঠিক ১২:১২ মিনিটে।
হঠাৎ করেই চারদিকে কান্নার আওয়াজ, যেন শত শত মানুষের শোকভরা আর্তনাদ মিলেমিশে একটা ভয়ঙ্কর সুর তৈরি করছে। অরিত্রর মাথা ঘুরে যায়। সে পড়ে যায় মেঝেতে। চিঠিটা এখনও তার হাতে ধরা। তার চোখে অন্ধকার নেমে আসে।
পরদিন সকালে গ্রামের লোকেরা তাকে খুঁজে পায় উঠোনে পড়ে থাকা অবস্থায়। তারা প্রথমে ভাবে, হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েছে। কিন্তু যখন জ্ঞান ফিরে আসে, সে নিঃশব্দে শুধু একটা কথা বলে—
“চিঠিটার শেষ লাইনটা আমি এখনও পড়িনি…”
0 Comments