শেষ ট্রেনের যাত্রী । ভূতের গল্প

                                                  

শেষ ট্রেনের যাত্রী

শেষ ট্রেনের যাত্রী

১৯৯৭ সালের এক শীতের রাত। নদীয়া জেলার এক ছোট রেলস্টেশন — ঘনটালা। জায়গাটা এখনকার কেউ চেনে না, গুগল ম্যাপে সার্চ করলেও নাম আসে না। কিন্তু সেই সময়, এটি ছিল একটি মাঝারি স্টেশন, যেখানে প্রতিদিন অন্তত পাঁচটা ট্রেন থামতো। এখান থেকেই শুরু হয় এক অদ্ভুত, ভয়াবহ রহস্যের গল্প। বলা হয়, এক রাতে "রানাঘাট লোকাল" নামে একটি ট্রেন ঘনটালা স্টেশন থেকে ছাড়ে, কিন্তু আর কোনওদিন তার গন্তব্যে পৌঁছায়নি। সেই ট্রেনে ছিল ৭২ জন যাত্রী, ৩ জন স্টাফ, এবং ১ জন গার্ড। ট্রেনটি মাঝরাতে হঠাৎ করেই অদৃশ্য হয়ে যায়। কোনও লাইন কাটা ছিল না, কোনও দুর্ঘটনার খবরও মেলেনি—কেবল নিখোঁজ এক সম্পূর্ণ ট্রেন। রেলওয়ে এই ঘটনাকে প্রথমে গুজব বলে উড়িয়ে দেয়, কিন্তু পরদিন সকালে স্টেশন মাস্টার অরবিন্দ বাবুকে খুঁজে পাওয়া যায় স্টেশন চত্বরে অজ্ঞান অবস্থায়, মুখে ফেনা, চোখ স্থির এবং তার পকেটে একটি ছোট্ট কাগজ—যেখানে লেখা ছিল, "সবাই ফিরে আসবে... কিন্তু অন্য রূপে।"

এরপর থেকেই ঘনটালা স্টেশন বন্ধ করে দেওয়া হয়। ধীরে ধীরে জায়গাটা জঙ্গলে ঢেকে যায়। কেউ সেখানে যায় না। তবে রাতের বেলা মাঝেমধ্যে লোকজন ট্রেনের হুইসেল শোনে—মাঝরাত ২:১৭-এ। কেউ বলে, তারা ট্রেনের আলো দেখতে পায় ঝোপের আড়ালে। কেউ বলে, সাদা পোশাকের এক লোক টিকিট কাউন্টারের সামনে দাঁড়িয়ে থাকে, তাকিয়ে থাকে, যেন সে কাউকে খুঁজছে।

বহু বছর পরে, ২০২3 সালে, তরুণ সাংবাদিক মণিষা দত্ত এই রহস্য নিয়ে প্রতিবেদন করতে আসেন ঘনটালায়। তিনি ভূত বা অতিপ্রাকৃত কিছুতে বিশ্বাস করেন না, বরং প্রমাণ চেয়ে তথ্য খোঁজেন। গ্রামের কিছু বয়স্ক মানুষ তাকে বলেন, “মাসিমা, ওই লাইনে সন্ধ্যা পেরোলেই একটা ঠান্ডা লাগে, আর পা যেন নিজের ইচ্ছায় চলে যায়।” তারা তাঁকে বাধা দিলেও মণিষা এক রাতে সাহস করে পৌঁছান সেই পুরনো স্টেশনে। সঙ্গী ছিল ক্যামেরা, টর্চ, আর মোবাইল। রাত তখন ঠিক ২টা ১৫ মিনিট। হঠাৎ করেই চারপাশটা যেন অদ্ভুত নিস্তব্ধ হয়ে যায়। একটাও ঝিঁঝিঁর ডাক নেই, বাতাস বন্ধ। ঠিক সেই মুহূর্তে তিনি দেখতে পান, অন্ধকার থেকে একটি ট্রেন আসছে… পুরনো কাঠের বগি, আলো টিম টিম করছে, জানালায় ছায়ামূর্তি, সব যেন স্বপ্ন আর দুঃস্বপ্নের মাঝামাঝি। ট্রেনটা স্টেশনে থামে, দরজা খুলে যায়।

কৌতূহলে পা বাড়ান মণিষা। হঠাৎ, তার পেছন থেকে কেউ বলে, “বহু বছর ধরে খালি ছিল এই আসনটা, এবার আপনি বসবেন তো?” তিনি ঘুরে দাঁড়িয়ে কাউকে দেখতে পান না। ঠিক তখনই তার টর্চ অফ হয়ে যায়, ক্যামেরা হ্যাং করে যায়, আর মোবাইলের স্ক্রীনে ভেসে ওঠে সেই পুরনো তারিখ—২২শে ডিসেম্বর, ১৯৯৭। যেন সময় পিছিয়ে যাচ্ছে। মণিষা ট্রেনের দিকে তাকিয়ে বোঝেন, প্রত্যেক যাত্রী যেন মৃত, চোখ নেই, মুখে ঠান্ডা হাসি। আর সবাই তাকিয়ে আছে তাঁর দিকে।

সকালে, মণিষার ফোন পাওয়া যায় স্টেশনের ধারে। ভিতরে রেকর্ড করা একটি ভিডিও, যেখানে ট্রেনের হুইসেল শোনা যায়, এবং একটি শেষ আওয়াজ—"আমিও এখন শেষ ট্রেনের যাত্রী..." তারপর সব ব্ল্যাঙ্ক। মণিষা আর কোনওদিন ফেরেননি। রেলওয়ে ফের ঘনটালার কথা অস্বীকার করে।

এখনও মাঝরাতে যদি কেউ নদীয়ার জঙ্গল পেরিয়ে ভুল করে ঘনটালার পুরনো লাইনের ধারে চলে যায়, সে নাকি শুনতে পায় এক পুরনো ট্রেনের চাকা ঘষার শব্দ, দূর থেকে হুইসেলের ডাক… আর ছায়ার মতো কেউ একজন ধীরে ধীরে বলে ওঠে—"চলে এসো… শেষ যাত্রা শুরু হোক…"

Follow For More

Post a Comment

0 Comments