পাহাড়পুরের সিঁড়িঘর | ভূতের গল্প

 

পাহাড়পুরের সিঁড়িঘর

পাহাড়পুরের সিঁড়িঘর

পাহাড়পুর একটি ছোট্ট পাহাড়ি গ্রাম, যেখানে মেঘ এসে দিনের বেলা পর্যন্ত ঘুমায়, আর রাত হলেই নেমে আসে এমন এক নীরবতা, যা শব্দের চেয়ে অনেক বেশি ভারী। এই গ্রামের কেন্দ্রে দাঁড়িয়ে আছে এক শতবর্ষ প্রাচীন জমিদারবাড়ি, যার পেছনের অংশটা এক সময় মন্দির ছিল—এখন সেটাই পরিত্যক্ত। কিন্তু গ্রামের লোকেরা বলে, ওটা আসলে একটা সিঁড়িঘর—যেখানে বসবাস করে “ও”। কে বা কী সেই ‘ও’, কেউ সঠিক জানে না। শুধু জানে, ওই ঘরের সিঁড়ি দিয়ে কেউ একবার নামলে আর উঠে আসেনি। বহু বছর আগে এই বাড়িতে বাস করতেন জমিদার হরিশংকর রায়, যিনি লোকদেখানো ধার্মিক হলেও ছিলেন এক রক্তচোষা লোভী। কথিত আছে, তিনি গোপনে কালজাদু করতেন, আর দেবতার নামে বলি দিতেন মানুষের। সেই অভিশপ্ত মন্দিরেই এক রাতে বলি দেওয়া হয়েছিল এক জ্যোতিষী মেয়েকে—নাম ছিল পদ্মমণি।

পদ্মমণি ছিল নিঃসন্তান বিধবা, কিন্তু ছিল দুর্দান্ত জ্যোতিষী ও গায়িকা। গ্রামের মানুষের বিশ্বাস, তার গলায় দেবী সরস্বতীর আশীর্বাদ ছিল। হরিশংকর তার বলি দিয়ে দেবতার কাছ থেকে অমরত্ব চেয়েছিল, কিন্তু সেই রাতেই ঝড় উঠেছিল পাহাড়ে। পদ্মমণির মৃতদেহ মিলেছিল সিঁড়িঘরের নিচে, মুখ ঘুরে থাকা, চোখ স্থির, আর ঠোঁটে জমে থাকা এক টুকরো গানের সুর। তারপর সেই বাড়ি বন্ধ করে দেওয়া হয়। কেউ ওখানে যায় না। বলা হয়, পদ্মমণির আত্মা আজও সিঁড়ি বেয়ে ওঠে আর নামে, আর তার পায়ের শব্দে বাতাসও থেমে যায়।

বছরের পর বছর পর, শহর থেকে আসে একজন ইতিহাসবিদ—ডঃ অরুণাভ দত্ত। তিনি ভূত বা অলৌকিকতায় বিশ্বাস করতেন না। তিনি খোঁজ পেয়ে এই পাহাড়পুরে আসেন, পুরোনো দলিল আর ভূগোল নিয়ে গবেষণা করতে। গ্রামের লোকেরা তাকে বারবার নিষেধ করে, বলে, “বাবু, সিঁড়িঘরে যাইবেন না, সেখান থেইকাও কেউ ফেরত আসে না।” কিন্তু অরুণাভ হাসেন, বলেন, “ভূতের চেয়ে ভয়ঙ্কর তো মানুষ নিজেই।”

রাত দশটায়, অরুণাভ তার ক্যামেরা, টর্চ, আর রেকর্ডার নিয়ে প্রবেশ করেন সেই পরিত্যক্ত বাড়ির ভিতরে। দরজা কিঞ্চিৎ খোলা ছিল, যেন কেউ অপেক্ষা করছিল তার জন্য। ভেতরে পা রাখতেই বাতাস যেন বদলে যায়—শুষ্ক, ভারী, আর অদ্ভুত একটা গন্ধ—পুরোনো ধূপ আর রক্তের। তিনি ধীরে ধীরে এগিয়ে যান সেই সিঁড়িঘরের দিকে। সিঁড়ির একেবারে নিচে দেখা যায় একটা ছায়া। প্রথমে অন্ধকার মনে হলেও একটু পরেই স্পষ্ট হয়—একজন নারী, সাদা শাড়ি, ভেজা চুল, চোখদুটি একদম ফাঁকা। মুখে একরাশ সুর, কিন্তু কণ্ঠ নেই। হঠাৎ, সেই নারী পেছন ঘোরে না—বরং সে ধীরে ধীরে সিঁড়ি বেয়ে উঠতে শুরু করে, কিন্তু তার পা মাটি ছুঁয়েই না।

অরুণাভ ভয়ে জমে যান, ক্যামেরা ফেলে দেন। ছায়ামূর্তি তার দিকে তাকিয়ে থাকে—নিস্তব্ধ, অথচ সে যেন বলে উঠেছে: “তুমি তো ইতিহাস জানতে এসেছো… এবার তুমি নিজেই ইতিহাস হয়ে যাও…” ঘরের বাতি নিভে যায়। আর তার পরদিন সকালে কেউ অরুণাভকে খুঁজে পায় না। তার রেকর্ডার উদ্ধার হয় সিঁড়ির পাশে। শেষ শব্দ শোনা যায়: “আমি গান শুনতে পাচ্ছি… সেই গান… পদ্মমণির গান…”

আজও, যদি কেউ ভুল করে রাত গভীরে পাহাড়পুরের ওই মন্দিরঘরের সিঁড়ির পাশে দাঁড়ায়, সে শোনে এক নারীর গলা… গানের সুরে ঢেকে থাকে তার আর্তনাদ… আর সিঁড়ির নিচ থেকে উঠে আসে এক ছায়া, যাকে কেউ থামাতে পারে না।

Follow for more

Post a Comment

0 Comments