নীলকুঠির অশরীরী | ভূতের গল্প

                                                       

Vuter golpo

নীলকুঠির অশরীরী

নদীয়ার প্রত্যন্ত গ্রাম ঘনশ্যামপুর যেন নিজের ভেতরেই বন্দী হয়ে আছে। প্রাচীন, নির্জন, আর ভয়ের চাদরে মোড়ানো এই গ্রামের ঠিক শেষ প্রান্তে দাঁড়িয়ে আছে বিশাল এক অট্টালিকা—যা স্থানীয়রা ‘নীলকুঠি’ নামে চেনে। ব্রিটিশ আমলের এই কুঠিতে একসময় ইংরেজ সাহেবরা জোর করে কৃষকদের দিয়ে নীলচাষ করাতো। গরীব চাষিদের উপর চলত অকথ্য নির্যাতন। সেই সময়ের সবচেয়ে কুখ্যাত সাহেব ছিলেন উইলিয়াম হ্যারি মুর—এক বর্বর, নির্মম এবং রক্তপিপাসু মানুষ। গ্রামের কেউ তাকে ভালোবাসতো না, কেবল ভয় করত। এই সাহেবের নজর পড়ে এক গরীব কৃষক কন্যার ওপর—কমলা। কমলা ছিল এক শান্ত স্বভাবের, সঙ্গীতপ্রীত মেয়ে। তার গানে ছিল প্রাণ, চোখে ছিল স্বপ্ন। একদিন সাহেব তাকে জোর করে তুলে নিয়ে যায় নীলকুঠিতে। সেই রাতের পরে আর কোনোদিন কমলাকে দেখা যায়নি। পরদিন তার নিথর দেহ পাওয়া যায় পেছনের কুয়োর পাশে, গলায় দাগ, চোখ দুটো খোলা, আর ঠোঁটে জমে থাকা অভিশপ্ত মৌনতা।

লোককথা বলে, মৃত্যুর আগে কমলা বলে গিয়েছিল, "এই নীলকুঠিতে আর শান্তি আসবে না… আমি এখানেই থাকব… প্রতিটি অন্যায় আমি ফিরিয়ে দেবো…"। তারপর থেকে কুঠিতে আর কেউ বাস করেনি। রাত হলেই কুয়োর পাশ থেকে শোনা যায় কান্না, কারও গুনগুন গান, আর মাঝেমধ্যে জানালার ফাঁকে দেখা যায় এক নারী – যার মুখ ঢাকা, কিন্তু যার উপস্থিতি জমিয়ে দেয় হাড়। পাখিরা উড়ে যায় দূরে, কুকুরেরা চিৎকার করে ওঠে, আর গ্রামের বয়স্ক মানুষরা কাঁপা কাঁপা গলায় বলে—“ওই নীলকুঠিতে আজও কমলা আছে।”

বহু বছর পর, ২০২২ সালে শহর থেকে চারজন তরুণ আসে—অভীক, রুদ্র, তিয়াসা ও জয়। তাদের ইউটিউব চ্যানেলের নাম "ভূতের দল"। তারা ইতিহাস ও হান্টেড স্থান নিয়ে ভিডিও তৈরি করে। কমলার গল্প শুনে তারা ঠিক করে, এক রাত কাটাবে নীলকুঠিতে, সব রেকর্ড করবে, প্রমাণ দেবে ‘ভূত’ বলে কিছু নেই। গ্রামের সবাই তাদের বারণ করে, কিন্তু তারা হাসে—তাদের জন্য ভূত মানে শুধু কনটেন্ট।

রাত ১১টা ৩০ নাগাদ তারা পৌঁছয় কুঠির সামনে। দরজার কড়া নাড়তেই যেন ভেতর থেকে নিঃশব্দে কেউ খুলে দেয়। ভিতরে ঢুকেই তারা দেখে ঘড়ির কাঁটা থেমে গেছে। সবার ঘড়ি একই সময়ে আটকে—১১:৩৪। হঠাৎ একটা হাওয়ার ঝাপটা আসে, অথচ সব জানালা বন্ধ। দেওয়ালের ওপর ছায়া পড়ে, অথচ সামনে কেউ নেই। তিয়াসা ক্যামেরা তুলে সামনে তাকাতেই চিৎকার করে ওঠে—“ওই দেখ, ওইটা কি?” তারা সবাই দেখে, সিঁড়ির মাথায় দাঁড়িয়ে এক সাদা শাড়ি পরা নারী, যার মুখ দেখা যাচ্ছে না, কিন্তু তার থেকে একটা ধোঁয়ার মতো ঠান্ডা ছায়া ছড়াচ্ছে।

তারা দৌড়ে ঘর থেকে বের হওয়ার চেষ্টা করে, কিন্তু দরজাগুলো বন্ধ হয়ে গেছে। জয় চিৎকার করে, রুদ্র বলে, “আমার মাথায় গান বাজছে—কমলার গান… আমি কানে শুনতে পাচ্ছি!” হঠাৎ তিয়াসা নিজেই নিজের আঙুলে কাচ দিয়ে কেটে দেয়—চোখে তার দৃষ্টি নেই, যেন ঘোরে আছে। অভীক ক্যামেরা নিয়ে এগিয়ে যায় কুয়োর দিকে, যেখানে দাঁড়িয়ে সেই নারী। এবার সে মুখ তোলে—চোখ নেই, গলার কাছে দাগ, কিন্তু তার ঠোঁটে লেগে আছে এক নিস্তব্ধ, থমথমে হাসি। সে বলে, “তোমরা জানতে এসেছো? এখন আমার সাথে থাকো… চিরকাল…”

পরদিন সকালে গ্রামের লোকজন দেখতে পায় কুঠির সামনে ক্যামেরা পড়ে আছে। চারজনের ব্যাগ ছড়িয়ে ছিটিয়ে, কিন্তু কারও কোনো খোঁজ নেই। ক্যামেরার শেষ রেকর্ডে দেখা যায়—অভীক এগিয়ে যাচ্ছে সেই মহিলার দিকে, ক্যামেরা ধীরে ধীরে ঘোলা হয়ে যাচ্ছে, আর শেষে শোনা যাচ্ছে সেই পুরোনো গানটা… সেই সুর… যেটা শুধু কমলা গাইতো।

আজও মাঝরাতে যদি কেউ সাহস করে কুঠির দিকে তাকায়, দেখে—চারটি ছায়ামূর্তি ক্যামেরা হাতে দাঁড়িয়ে আছে, তাদের ঠোঁটে গেঁথে আছে সেই একই অভিশপ্ত হাসি। তারা এখন চায় নতুন গল্প… নতুন মুখ… নতুন কেউ, যে আবার বলবে—“ভূত বলে কিছু নেই।”

Follow for More

Post a Comment

0 Comments