ভূতের হাসি | ভূতের গল্প

 

ভূতের হাসি

ভূতের হাসি

প্রথম অধ্যায় – অভিশপ্ত অতীত

রঘুনাথপুর গ্রাম এককালে ছিল জমিদারি শাসনের অধীনে। সেই সময়ের সবচেয়ে ক্ষমতাধর জমিদার ছিলেন রাজেন্দ্র নারায়ণ রায়। তিনি ছিলেন এক নিষ্ঠুর, সন্দেহপ্রবণ এবং অহংকারী ব্যক্তি। তার স্ত্রী সরলা ছিল একেবারে উল্টো – নম্র, শিক্ষিতা এবং সবার প্রিয়। গ্রামের মানুষ সরলাকে "দেবী" বলে ডাকত।

কিন্তু জমিদার রাজেন্দ্র দিনের পর দিন সরলার উপর সন্দেহ করতে শুরু করেন। কথায় কথায় রাগারাগি, গৃহস্থালির কাজকর্মে নজরদারি, এমনকি তাঁকে ঘরের বাইরে বের হতেও দিতেন না।

একদিন হঠাৎ জমিদারের কানে ভুল খবর পৌঁছায় – যে নাকি সরলা তাঁর এক পুরোনো বন্ধু বিষ্ণুর সঙ্গে গোপনে দেখা করে। সেই রাত্রে, তীব্র রাগ আর হিংসার বশে রাজেন্দ্র স্ত্রীকে এক পুরনো গুপ্তঘরে বন্দী করে আগুন লাগিয়ে দেয়।

মৃত্যুর আগমুহূর্তে সরলার কণ্ঠস্বর ছড়িয়ে পড়ে অন্ধকারে —
"যে আমার হাসিকে কাঁদায়, আমি তার কাঁদাকেই হাসিতে পরিণত করবো... ভয়ংকর হাসি!"

এরপর থেকে সেই বাড়িতে নিয়মিত অদ্ভুত ঘটনা ঘটতে থাকে। রাজেন্দ্র পাগল হয়ে যায়। ছাদের কিনারা থেকে ঝাঁপ দিয়ে জীবন শেষ করে। কিন্তু তার মৃত্যুতে অভিশাপের পরিসমাপ্তি হয়নি।

দ্বিতীয় অধ্যায় – গ্রামের বদলানো চেহারা

বছর কেটে যায়, জমিদার বাড়ি পরিণত হয় ভগ্ন খণ্ডহরে। কিন্তু রাতে পাশ দিয়ে যাওয়া মানুষেরা বলেন— "একটা মেয়ের হাসির আওয়াজ শুনি, যেন কারো হৃদয় বিদীর্ণ করার জন্য সে খিলখিল করে হাসে।"

অনেকে বলেন, এক মহিলা সাদা শাড়ি পরে বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকেন, তাঁর চোখ নেই, মুখটা ফাঁকা, কিন্তু গলার আওয়াজ যেন একসাথে অনেকজনের হাসি একত্রে!

গ্রামে কিছু অদ্ভুত ঘটনাও ঘটতে থাকে—

  • একবার, এক কাঠুরে রাতে পথ হারিয়ে খণ্ডহরের পাশ দিয়ে যাচ্ছিল। সকালে তাঁর দেহ পাওয়া যায় গাছতলায়, চোখদুটো ছিল খোলা, কিন্তু ঠোঁটে জমে থাকা হাসি ছিল অস্বাভাবিক ঠান্ডা।

  • গ্রামের কুকুরগুলো রাত হলেই চেঁচাতে থাকে সেই দিকের দিকে তাকিয়ে।

তৃতীয় অধ্যায় – অর্ণবের আগমন

শহরের তরুণ, আধুনিক মনস্ক, টেক-স্যাভি অর্ণব তার মামার বাড়িতে আসে। সে ফটোগ্রাফি করে, ভ্লগ বানায়, আর সবচেয়ে বড় কথা, ভূতের গল্পকে একদম বিশ্বাস করে না। একদিন সন্ধ্যায় গ্রামের মোড়ে বসে সে শুনে সেই জমিদার বাড়ির গল্প।

— “ভূতের হাসি? ওটা একটা সাইকোলজিক্যাল ইফেক্ট, ভাই। আমি কাল রাতেই ওখানে ঘুরে আসব। ক্যামেরা নিয়ে যাব, প্রমাণ দেব – ভূত বলে কিছু নেই।”

গ্রামের বয়স্করাও তাকে মানা করে, কিন্তু তার কৌতূহল আর সাহসের কাছে তা কিছুই না।

চতুর্থ অধ্যায় – রাত বারোটার অভিশাপ

রাত ১১:৫০, অর্ণব রেডি। হাতে টর্চ, কাঁধে ব্যাগ, তাতে ক্যামেরা আর ভয় কাটানোর জন্য হেডফোনে বাজছে একদম হাই বীট মিউজিক।

১২টা বাজার আগেই সে জমিদার বাড়ির সামনে দাঁড়ায়।

ঘরটা অদ্ভুত ঠান্ডা, অথচ বাতাসই নেই। দরজা নিজেই যেন একটু একটু করে খুলে যায়। অর্ণব ভেতরে পা রাখতেই — ঠক ঠক ঠক, পেছনের দরজা বন্ধ।

সে প্রথমে ভাবে এটা বাতাসের কাজ। কিন্তু হঠাৎ দেয়ালে একটা শব্দ— “হি... হি... হি...”

সে পেছনে তাকায়। কেউ নেই।

সে ক্যামেরা তুলে ছবি তোলে। কিন্তু স্ক্রিনে যা দেখে তাতে তার গলা শুকিয়ে যায়— ছবিতে তার পেছনে দাঁড়িয়ে এক নারী, কাঁধ পর্যন্ত চুল, মুখে অদ্ভুত হাসি, আর চোখের জায়গায় শূন্যতা।

পঞ্চম অধ্যায় – সরলার আবির্ভাব

হঠাৎ অর্ণবের সামনে দেওয়াল থেকে গলে বেরিয়ে আসে সেই নারী – সরলা!
সে ধীরে ধীরে বলে,
"তুই হাসি দেখাতে এসেছিস? হাসার সময় এখন আমার..."

তারপরেই সেই একসাথে বহু কণ্ঠের ঠান্ডা, ঠাণ্ডা হাসি – হি হি হি হি হি…
অর্ণব ছুটতে চেষ্টা করে, কিন্তু পায়ে পা জড়িয়ে যায়, চোখের সামনে সব ঝাপসা হতে থাকে।

শেষবার, সে শুধু দেখতে পায় — নিজের ক্যামেরার স্ক্রিনে, তার মুখে জুড়ে গেছে সেই একই ঠান্ডা, অস্বাভাবিক হাসি।

শেষ অধ্যায় – নতুন মুখ, পুরনো অভিশাপ

পরদিন ভোরে, গ্রামের দুই কিষাণ জমিতে জল দিতে গিয়ে দেখে – খণ্ডহরের সামনে পড়ে আছে একটা ক্যামেরা। তাতে রেকর্ড করা শেষ ক্লিপে দেখা যায় অর্ণব নিজের দিকে তাকিয়ে হাসছে... তারপর একটা ফিসফিসানি —
“হাসো… কারণ ভয় পেতে শেখার এটাই শুরু!”

অর্ণবকে আর কেউ খুঁজে পায়নি।

কিন্তু আজও, রঘুনাথপুরের সেই খণ্ডহরে নতুন এক ছায়া দেখা যায় – অর্ণবের মতো দেখতে একজন, যিনি রাতের বেলা শুধু হাসেন।

Post a Comment

0 Comments