পুরোনো বাড়ির রহস্য
অমাবস্যার রাত। আকাশে চাঁদের কোনো চিহ্ন নেই, শুধু তারার ঝিকিমিকি আর ঝড়ের পূর্বাভাস নিয়ে বাতাসে একটা অদ্ভুত শনশন শব্দ। গ্রামের শেষ প্রান্তে, যেখানে কেউ সহজে পা মাড়ায় না, সেখানে দাঁড়িয়ে আছে একটা পুরোনো জরাজীর্ণ হaveli—মানে, বড়সড় একটা বাড়ি। গ্রামের লোকেরা বলে, এই বাড়িতে নাকি ভূতের বাস। কেউ বলে, এক শতাব্দী আগে এখানে এক ধনী জমিদার থাকতেন, নাম রাজেন্দ্র নারায়ণ। তার মৃত্যুর পর থেকেই বাড়িটা অভিশপ্ত। কিন্তু কেউ ঠিক জানে না, কী ঘটেছিল সেই রাতে।
এই গল্পের নায়ক হলো আরিফ। বয়স ২৫, শহরের ছেলে, পড়াশোনা শেষ করে গ্রামে এসেছে তার বন্ধু রাহুলের আমন্ত্রণে। রাহুল গ্রামের ছেলে, সবসময় অ্যাডভেঞ্চারের পিছনে ছুটত। ওরা দুজন মিলে ঠিক করল, ওই পুরোনো বাড়িতে এক রাত কাটাবে। আরিফ প্রথমে রাজি ছিল না, কিন্তু রাহুলের জেদের কাছে হার মানল। তাছাড়া, আরিফের মনে একটা কৌতূহলও জেগেছিল—সত্যিই কি ভূত থাকে?
দুজনে ব্যাগ গুছিয়ে, টর্চ, খাবার আর ক্যামেরা নিয়ে বাড়িটার দিকে রওনা দিল। বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা নামছিল। বাড়িটার কাছে পৌঁছতেই আরিফের বুকটা কেমন ধক করে উঠল। বিশাল লোহার গেট, মরচে পড়া, একটা অদ্ভুত শব্দ করে খুলল। ভেতরে পা রাখতেই ঠান্ডা বাতাসের ঝাপটা এলো, যেন কেউ ফিসফিস করে বলছে, "ফিরে যাও।"
বাড়ির ভেতরটা ছিল ধুলো আর মাকড়সার জালে ভরা। পুরোনো আসবাব, ভাঙা ঝাড়বাতি, আর দেয়ালে কিছু পুরোনো ছবি। একটা ছবিতে একজন লোকের মুখ ছিল, চোখ দুটো যেন জীবন্ত। রাহুল হেসে বলল, "এটা নিশ্চয়ই রাজেন্দ্র নারায়ণ। বেশ হ্যান্ডসাম ছিল, না?" আরিফ কিছু বলল না, কিন্তু তার মন বলছিল, এই ছবির চোখ যেন তাদের ফলো করছে।
রাত বাড়ার সাথে সাথে পরিবেশ আরও ভারী হয়ে উঠল। ওরা একটা বড় হলঘরে বসে গল্প করছিল। হঠাৎ একটা শব্দ—ঠক... ঠক... ঠক। যেন কেউ সিঁড়ি দিয়ে নামছে। আরিফ টর্চ জ্বালিয়ে বলল, "কে ওখানে?" কোনো উত্তর নেই। রাহুল হাসতে হাসতে বলল, "ওটা বোধহয় বাতাসে কিছু পড়েছে। ভয় পাস না, ব্রো!" কিন্তু আরিফের মনে শান্তি ছিল না।
কিছুক্ষণ পরে, আরিফের ক্যামেরায় একটা অদ্ভুত ছবি ধরা পড়ল। ওরা যখন ছবিটা দেখল, তখন দুজনেরই মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গেল। ছবিতে ওদের পেছনে একটা ছায়া ছিল—একটা লম্বা, কালো আকৃতি, যার মুখ ছিল না। রাহুল এবারেও হাসার চেষ্টা করল, কিন্তু তার গলা শুকিয়ে গিয়েছিল।
রাত তখন প্রায় ১২টা। হঠাৎ বাড়ির ভেতর থেকে একটা মেয়ের কান্নার শব্দ ভেসে এলো। আরিফ বলল, "এটা আর মজা না, রাহুল। চল, বেরিয়ে যাই।" কিন্তু রাহুল জেদ ধরল, "আরে, এটা নিশ্চয়ই কোনো প্র্যাঙ্ক। আমরা দেখব কী হচ্ছে!" ওরা শব্দের দিকে এগিয়ে গেল। শব্দটা আসছিল দোতলার একটা বন্ধ ঘর থেকে। দরজাটা খোলার চেষ্টা করতেই একটা ঠান্ডা হাওয়া বেরিয়ে এলো, আর সাথে একটা ফিসফিস— "তুমি এখানে কেন?"
দরজা খুলতেই ওরা দেখল, ঘরের মাঝখানে একটা পুরোনো আয়না। আয়নার সামনে একটা মেয়ের ছায়া দাঁড়িয়ে। তার পরনে ছিল সাদা শাড়ি, মাথায় ঘোমটা, আর হাতে একটা ছোট্ট বাক্স। আরিফের হাত-পা ঠান্ডা হয়ে গেল। রাহুল চিৎকার করে বলল, "এটা কে?!" ছায়াটা ধীরে ধীরে ফিরল, আর তখনই ওরা দেখল—তার মুখে চোখ নেই, শুধু দুটো কালো গর্ত।
আরিফ আর রাহুল দৌড়ে পালাতে শুরু করল। কিন্তু সিঁড়ি দিয়ে নামার সময় পেছন থেকে একটা হাসির শব্দ শুনল—একটা পুরুষের গম্ভীর হাসি। আরিফ ফিরে তাকাতেই দেখল, দেয়ালের ছবির লোকটা আর ছবিতে নেই। তার বদলে ছবিতে শুধু একটা কালো ছায়া।
ওরা কোনোরকমে বাড়ি থেকে বেরিয়ে এলো। গ্রামে ফিরে গ্রামের বুড়ো মানিক কাকার কাছে গল্পটা বলল। মানিক কাকা গম্ভীর হয়ে বললেন, "তোরা বেঁচে ফিরেছিস, এটাই অনেক। ওই বাড়িতে রাজেন্দ্র নারায়ণের আত্মা আর তার মেয়ে রুক্মিণীর আত্মা আটকে আছে। রাজেন্দ্র নিজের মেয়েকে মেরেছিল একটা রত্নের বাক্সের জন্য। তারপর থেকে ওরা শান্তি পায়নি। যে ওই বাড়িতে যায়, তাকে ওরা ছাড়ে না।"
আরিফ আর রাহুল আর কখনো ওই বাড়ির দিকে ফিরেও তাকায়নি। কিন্তু আরিফের ক্যামেরায় সেই ছবিটা এখনো আছে। আর মাঝে মাঝে, রাতের বেলা, আরিফের কানে একটা ফিসফিস ভেসে আসে— "বাক্সটা কোথায়?"
0 Comments