নিশির ডাক । ভূতের গল্প

                                         

নিশির ডাক

নিশির ডাক

অনেক বছর আগে, বাংলার এক প্রত্যন্ত গ্রামে, যেখানে ধানের খেত শেষ হয়ে জঙ্গল শুরু হতো, সেখানে ছিল একটা পুরনো হাভেলি। হাভেলিটার নাম ছিল "নীলকুঠি"। বয়স্করা বলতেন, এটা একসময় জমিদারদের বাসস্থান ছিল, কিন্তু এখন শুধুই ধ্বংসস্তূপ। দেয়ালে ফাটল, জানালার কাচ ভাঙা, আর ছাদের কিছু অংশ ধসে পড়েছে। রাত হলেই হাভেলি থেকে অদ্ভুত শব্দ ভেসে আসত—মেঝেতে ভারী পায়ের শব্দ, ফিসফিস করে কথা বলা, আর কখনো কখনো একটা মেয়ের হৃদয়বিদারক কান্না। গ্রামের লোকেরা বলত, ওই হাভেলিতে একটা অতৃপ্ত আত্মা বাস করে, যে কাউকে ছাড়ে না। কেউ কেউ শপথ করে বলত, তারা পূর্ণিমার রাতে হাভেলির জানালায় একটা ছায়া দেখেছে—লাল শাড়ি পরা, লম্বা চুল, আর চোখে অদ্ভুত দীপ্তি।

গ্রামের কেউ হাভেলির ধারেকাছে যেত না। পথচারীরা রাতে ওই পথ দিয়ে যাওয়ার সময় দ্রুত পা চালাত, আর বাচ্চারা দিনের বেলাতেও ওদিকে তাকাত না। কিন্তু রাহুল, একজন তরুণ, যে শহর থেকে গ্রামে ফিরেছিল তার দাদুর অসুস্থতার কারণে, এই গল্পে একদমই বিশ্বাস করত না। সে বলত, "এসব কুসংস্কার! হয়তো বাতাসের শব্দ বা কোনো পশুর আওয়াজ।" গ্রামের লোকেরা তাকে সাবধান করলেও, রাহুলের কৌতূহল তাকে টানছিল। সে ঠিক করল, সে হাভেলির রহস্য ভেদ করবেই।

এক পূর্ণিমার রাতে, যখন আকাশে চাঁদ ঝকঝকে আলো ছড়াচ্ছিল, রাহুল প্রস্তুত হলো। হাতে একটা শক্তিশালী টর্চ, পকেটে তার দাদুর দেওয়া একটা পুরনো তাবিজ, আর কাঁধে একটা ছোট ব্যাগ, যাতে ছিল পানির বোতল আর একটা ছুরি। তার দাদু শেষবার তাকে সাবধান করে বলেছিলেন, "ওই জায়গায় অন্ধকারের চেয়েও ভয়ানক কিছু আছে। ফিরে আয়, বাবু।" কিন্তু রাহুল হেসে উড়িয়ে দিয়েছিল।

হাভেলির দরজায় পৌঁছে রাহুলের বুকটা একটু ধক করে উঠল। বিশাল কাঠের দরজাটা খোলা ছিল, যেন তাকে আমন্ত্রণ জানাচ্ছে। ভেতরে ঢুকতেই ঠাণ্ডা হাওয়ার একটা ঝাপটা এলো, যেন কেউ তার গায়ে ফুঁ দিল। টর্চের আলোতে দেখা গেল, হলঘরের মেঝেতে ধুলো জমে আছে, দেয়ালে পুরনো পেইন্টিং ঝুলছে, আর সিঁড়ির কাছে একটা ভাঙা ঝাড়বাতি দুলছে। চাঁদের আলো জানালা দিয়ে এসে মেঝেতে অদ্ভুত ছায়া ফেলছিল, যেন কেউ নড়ছে।

রাহুল এগিয়ে গেল। হঠাৎ সে শুনল, কেউ তার নাম ধরে ডাকছে—"রাহুুুল..."। কণ্ঠটা মিষ্টি, কিন্তু এত ঠাণ্ডা যে তার শিরদাঁড়া দিয়ে শীতল স্রোত বয়ে গেল। সে টর্চ ঘুরিয়ে চারপাশ দেখল, কিন্তু কেউ নেই। "কে? কে ওখানে?" সে চিৎকার করল। জবাবে শুধু নিস্তব্ধতা, আর দূর থেকে একটা কাঠের মেঝে ক্যাঁচ করে ওঠার শব্দ।

সাহস সঞ্চয় করে রাহুল ওপরের তলায় উঠতে শুরু করল। সিঁড়ির প্রতিটা ধাপে কাঠের ক্যাঁচক্যাঁচ শব্দ হচ্ছিল, আর তার মনে হচ্ছিল, যেন কেউ তার পিছু নিয়েছে। ওপরে পৌঁছে সে একটা লম্বা করিডোর দেখল, যেখানে দুপাশে বন্ধ দরজা। শেষের দরজাটা একটু ফাঁক ছিল, আর ভেতর থেকে একটা মৃদু আলো বেরোচ্ছিল। রাহুলের কৌতূহল তাকে টানল।

দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকতেই সে থমকে গেল। ঘরের মাঝে একটা পুরনো আয়না, আর তার সামনে একটা ভাঙা চেয়ার। আয়নায় তার নিজের প্রতিবিম্বের পাশে সে দেখল একটা মেয়েকে—লাল শাড়ি, লম্বা কালো চুল, চোখে গাঢ় কাজল, কিন্তু মুখটা ফ্যাকাসে, প্রায় সাদা। মেয়েটার ঠোঁটে হাসি, কিন্তু চোখে এমন একটা শূন্যতা যে রাহুলের হাত-পা ঠাণ্ডা হয়ে গেল। "আমার সাথে খেলবে, রাহুল?" মেয়েটা বলল, তার কণ্ঠ এবার আরো কাছে, যেন কানের পাশে ফিসফিস করছে।

রাহুল পিছিয়ে যেতে গিয়ে দেখল, দরজা বন্ধ হয়ে গেছে। সে চিৎকার করে দরজায় ধাক্কা দিল, কিন্তু কিছুতেই খুলছে না। হঠাৎ টর্চটা নিভে গেল। অন্ধকারে শুধু মেয়েটার হাসির শব্দ, আর তারপর একটা ঠাণ্ডা হাত তার কাঁধে। "ভয় পাচ্ছ কেন? আমি তো তোমার বন্ধু," মেয়েটা বলল। রাহুলের মনে হলো, তার শরীরের সব শক্তি কেউ যেন শুষে নিচ্ছে। সে তাবিজটা শক্ত করে ধরল, আর মনে মনে তার দাদুর শেখানো একটা মন্ত্র পড়তে শুরু করল।

কীভাবে যেন সে দরজা খুলে পালাল। সিঁড়ি দিয়ে প্রায় গড়িয়ে নিচে নেমে এলো। হাভেলির বাইরে পৌঁছতেই সে মাটিতে লুটিয়ে পড়ল। তার হাতে একটা পুরনো লকেট ছিল, যেটা সে কখনো দেখেনি। ভোর হতেই গ্রামের লোক তাকে অজ্ঞান অবস্থায় পেল।

রাহুল বেঁচে ফিরলেও আর কখনো হাভেলির কথা মুখে আনল না। তার চোখে একটা অদ্ভুত ভয় লেগে থাকত। গ্রামের লোক বলে, পূর্ণিমার রাতে এখনো নীলকুঠি থেকে কেউ একজন ছেলের নাম ধরে ডাকে। আর যারা কাছ দিয়ে যায়, তারা শুনতে পায়—একটা মেয়ের ফিসফিস, "আমার সাথে খেলবে?"

Follow For More

Post a Comment

0 Comments