⛔ তাঁতি বাড়ির কালো জাদু ⛔

যশোর জেলার মনিরামপুর উপজেলার এক প্রত্যন্ত গ্রামে। গ্রামটি বেশ পুরোনো, লোকসংখ্যা বেশি নয়, আর চারপাশটা ধানক্ষেত আর বিলে ঘেরা। গ্রামের মেঠোপথ দিয়ে হাঁটতে গেলে দুপুরের পরপরই যেন একটা নিস্তব্ধতা নেমে আসে। বাজার দূরে, সন্ধ্যার পর পুরো গ্রাম অন্ধকারে ঢেকে যায়। গ্রামের পুরোনো লোকেরা বলে, এই গ্রামটা একসময় তাঁতিদের গ্রাম ছিল। প্রায় একশো বছর আগেও এখানে তাঁতিরা কাপড় বুনে জীবিকা নির্বাহ করত। কিন্তু একদিন হঠাৎ করেই সব বদলে গেল।

---

গ্রামের পাশেই একটা পরিত্যক্ত বাড়ি আছে, যেটাকে সবাই "তাঁতি বাড়ি" বলে। ছোটবেলা থেকে শুনে আসছি, এই বাড়িতে একসময় এক বিত্তশালী তাঁতি পরিবার বাস করত। তারা শুধু কাপড় বুনতো না, বরং নাকি এক গোপন বিদ্যায় পারদর্শী ছিল। গ্রামের লোকেরা মুখে মুখে বলত, ওই পরিবারের পুরুষেরা তাঁতের সুতোতে এমন এক শক্তি দিত, যা সাধারণ সুতো ছিল না। কেউ কেউ বলত, এই সুতো দিয়ে বানানো কাপড় পরলে লোকের শরীরে অদ্ভুত পরিবর্তন আসত—কেউ খুব সৌভাগ্যবান হয়ে যেত, কেউ আবার কয়েক দিনের মধ্যে অদ্ভুত রোগে আক্রান্ত হতো।

একসময় গ্রামের লোকেরা লক্ষ্য করল, তাঁতি পরিবারের কয়েকজন পুরুষ রাতে কোথাও যেত। দিনের বেলা তারা স্বাভাবিক থাকলেও, রাতে তাদের চোখের নিচে কালি পড়ে যেত, মুখ শুকিয়ে যেত। তাদের স্ত্রীদের মুখে কোনোদিন হাসি দেখা যেত না, আর আশেপাশের লোকজন বলত, তাঁতি বাড়ির উঠান থেকে মাঝে মাঝে অদ্ভুত সব পশুর ডাক শোনা যেত।

গ্রামের কিছু সাহসী লোক একদিন রাতের বেলা তাঁদের অনুসরণ করল। তারা দেখল, তাঁতিরা গ্রাম থেকে বেশ খানিকটা দূরে এক পুরোনো আমবাগানের ভেতরে ঢুকল। সেখানে আগুন জ্বলছিল, আর তাঁতিরা কিছু একটা জপছিল। পরদিন সকালে এক অদ্ভুত ঘটনা ঘটল—গ্রামের সবচেয়ে ধনী কৃষকের গরুগুলো একসঙ্গে মারা গেল! লোকজন বলাবলি করতে লাগল, তাঁতিরা কোনো গোপন শক্তি ব্যবহার করছে, যা গ্রামের মানুষদের ক্ষতি করছে।

এক রাতে, গ্রামের কয়েকজন সাহসী যুবক সিদ্ধান্ত নিল, তাঁতি বাড়িতে গিয়ে আসল ঘটনা জানবে। তারা বাড়ির পেছনের ছোট্ট জানালা দিয়ে উঁকি দিল এবং যা দেখল, তা তারা জীবনে ভুলতে পারেনি।

তাঁতি পরিবারের কর্তা, একজন বয়স্ক লোক, একটা পাথরের উপর বসে আছে। সামনে একটা বিশাল তাঁত মেশিন, আর তাতে বোনা হচ্ছে কালো রঙের সুতো! সেই সুতোর গায়ে একটা লাল আভা খেলা করছিল। আর আশেপাশে রাখা ছিল কিছু মাটির পাত্র, যার মধ্যে অদ্ভুত গন্ধযুক্ত কালি জাতীয় কিছু তরল।

যুবকদের একজন ভুল করে একটা পাথর ফেলে দেয়, আর সঙ্গে সঙ্গে তাঁতিরা ছুটে আসে। তারা যুবকদের টেনে ধরে এবং বলে—

"তোমরা যা দেখেছ, তা কাউকে বলবে না। আমাদের তাঁতশিল্প শুধু কাপড় বোনার জন্য নয়, এটা রক্ষা করার জন্য আমাদের পূর্বপুরুষদের আত্মা পর্যন্ত বিক্রি করতে হয়েছে!"

সেই রাতের পর থেকে, গ্রামের লোকেরা লক্ষ্য করল, তাঁতি পরিবারের প্রায় সবাই একে একে হারিয়ে যেতে লাগল। কেউ নিখোঁজ হয়ে গেল, কেউ বা অসুস্থ হয়ে মারা গেল। বাড়িটা একসময় পুরোপুরি ফাঁকা হয়ে গেল, আর ধীরে ধীরে তাঁতি শিল্পও হারিয়ে গেল।

---

অনেক বছর পর, আমাদের বাড়ির এক আত্মীয় সেই তাঁতি বাড়ির পাশেই নতুন ঘর বানিয়ে থাকতে শুরু করল। প্রথমদিকে সব ঠিকঠাক ছিল, কিন্তু কয়েক মাস যেতে না যেতেই অদ্ভুত ঘটনা ঘটতে লাগল।

✅ তাদের গৃহপালিত প্রাণীগুলো হঠাৎ করেই মারা যেতে লাগল।

✅ রাতে বাড়ির উঠানে কালো পোড়া সুতো পাওয়া যেতে লাগল, যা কোনোভাবেই আগুনে পুড়ছিল না।

✅ পরিবারের কেউ কেউ মাঝরাতে অনুভব করত, যেন শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে, কিন্তু কোনো ডাক্তারি পরীক্ষায় কিছু ধরা পড়ত না।

একদিন, সেই পরিবারের কর্তা গ্রামের এক বৃদ্ধ লোককে জিজ্ঞেস করল, "এমনটা কেন হচ্ছে?"

বৃদ্ধ শুধু একটা কথাই বলল—

"তাঁতিরা চলে গেছে, কিন্তু তাদের কাজের ফল রয়ে গেছে।"

এই ঘটনার পর সেই পরিবার আর বেশি দিন সেখানে থাকেনি। তাঁরা অন্য জায়গায় চলে গেল, কিন্তু তাঁতি বাড়ি এখনো সেই একই জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে, সময়ের সাক্ষী হয়ে। আজও কেউ সন্ধ্যার পর ওই বাড়ির কাছে যায় না, আর কেউ ভুল করেও সেখানে কোনো কাপড় মেলে দেয় না, কারণ বিশ্বাস করা হয়—সেই কালো সুতো এখনো বাতাসে ভেসে বেড়ায়...

Post a Comment

0 Comments