যোগী বাবা | ভূতের গল্প

                            

যোগী বাবা

                                যোগী বাবা

বাংলাদেশের এক প্রত্যন্ত অঞ্চলে ছিল এক নিরিবিলি ছোট্ট গ্রাম। এ গ্রামের পাশ দিয়ে বয়ে চলত গভীর আর ভয়ংকর এক নদী। নদীটি যেন জীবন্ত—রাতের বেলায় তা থেকে উঠত অদ্ভুত আওয়াজ। নদীর মাঝখানে ছিল একটি গুহা, যাকে স্থানীয়রা "যুগির গোফা" নামে চিনত। কথিত আছে, এই গুহাটি কখনো পানির তলে তলিয়ে যেত, আবার হঠাৎই পানির উপর ভেসে উঠত। গুহার চারপাশে অন্ধকার আর ভয়ানক নীরবতা লুকিয়ে থাকত।

গ্রামের মানুষেরা বলত, বহু বছর আগে এই গুহায় এক সাধু পুরুষ—"যোগী বাবা"—ধ্যানমগ্ন থাকতেন। তার ধ্যান ভঙ্গ করার সাহস কারো ছিল না। কিন্তু এক রাতে লোভী কিছু মানুষ গুহায় ঢুকে তার ধন-সম্পদ লুট করতে গিয়ে অভিশপ্ত হয়ে যায়। তারা কখনো আর গ্রামে ফিরতে পারেনি। পরদিন সকালে তাদের লাশ ভেসে ওঠে নদীর পাড়ে, কিন্তু তাদের চোখ খোলা আর মুখে জমে থাকা আতঙ্কের ছাপ দেখে বোঝা যেত, মৃত্যুর আগে তারা কিছু ভয়াবহ জিনিস দেখেছিল। সেই থেকে গুহাটি হয়ে ওঠে একটি আতঙ্কের স্থান।

সেই ভয়াবহ কাহিনি সত্ত্বেও গ্রামের তিন যুবক—সাকিব, রাফি, আর তুহিন—যুগির গোফার রহস্য উন্মোচনের সিদ্ধান্ত নেয়। তারা মনে করেছিল, সবটাই হয়তো কুসংস্কার। কিন্তু তাদের জানা ছিল না, তারা নিজেরাই এক ভয়াবহ ভাগ্যের দিকে এগিয়ে চলেছে।এক পূর্ণিমার রাতে তারা নৌকা নিয়ে রওনা দিল। নদীর পানি ছিল অদ্ভুত শান্ত, যেন সেই রাতের প্রকৃতিতে কোনো লুকানো সতর্কবার্তা ছিল। তারা যখন গুহার কাছে পৌঁছাল, চারপাশের পরিবেশ হঠাৎই অস্বাভাবিক ঠাণ্ডা হয়ে গেল। বাতাস বন্ধ হয়ে গেল, আর নদীর পানিতে তাদের নৌকার প্রতিবিম্বও যেন থেমে গেল।

তিন বন্ধু গুহায় প্রবেশ করল। গুহার দেয়ালে ছিল ভয়ংকর চিত্র। মনে হচ্ছিল, চিত্রগুলো থেকে কিছু অদ্ভুত জীব তাদের দিকে তাকিয়ে আছে। হঠাৎ তারা গুহার ভেতর থেকে শোনা গেল চাপা কণ্ঠস্বর—কেউ যেন খুব কাছে থেকে তাদের নাম ধরে ডাকছে।

রাফি এগিয়ে গিয়ে একটি পুরনো মাটির প্রদীপ তুলে নিল। সেই মুহূর্তেই গুহার চারপাশের বাতাস যেন কাঁপতে শুরু করল। গুহার দেয়ালে আঁকা চিত্রগুলো জীবন্ত হয়ে উঠল। মেঝে থেকে উঠে এল মানুষের কঙ্কাল, যেগুলোর হাড়ে ছিল জং ধরা লোহার শিকল।

হঠাৎ এক ছায়ামূর্তি তাদের সামনে হাজির হলো। মূর্তিটির গায়ের গঠন মানুষের মতো, কিন্তু মুখ ছিল আগুনের মতো লাল। তার কণ্ঠে ছিল বজ্রের মতো ভয়ংকর গর্জন। সে চিৎকার করে বলল, "তোমরা কেন এসেছ আমার অভিশপ্ত স্থানে? এখান থেকে কেউ জীবিত যায় না!"

তুহিন ভয় পেয়ে দৌড় দিতে গিয়ে পড়ে গেল। তার শরীরের ওপর হঠাৎ একটি অদৃশ্য শক্তি চেপে বসল। সে কাঁপতে কাঁপতে চিৎকার করতে লাগল। রাফি আর সাকিব সাহায্য করতে এগিয়ে গেল, কিন্তু সেই ছায়ামূর্তি তাদের ঘিরে ধরল।

মূর্তিটি গর্জন করে উঠল, "তোমরা আমার ধ্যান ভঙ্গ করলে, এখন তোমাদের আত্মাও এই নদীতে বন্দি থাকবে!"গুহার মেঝে হঠাৎ ফেটে গেল, আর তিন বন্ধু একটি ঘূর্ণি জলের মধ্যে তলিয়ে গেল। তারা অনুভব করল, যেন কোনো অদৃশ্য হাত তাদের পায়ের নিচ থেকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। চারদিকে ছিল অন্ধকার, আর কানে আসছিল মরে যাওয়া মানুষের আর্তনাদ।

তাদের জ্ঞান যখন ফিরল, তখন তারা নদীর তীরে পড়ে ছিল। চারদিকে স্রেফ নীরবতা। কিন্তু তাদের শরীরে গভীর পোড়া দাগ আর চোখে আতঙ্কের ছাপ। গ্রামে ফিরে তারা কিছু বলতে পারেনি। শুধু জানত, তারা যে ভয়াবহ অভিশাপের মুখোমুখি হয়েছিল, তা কাউকে বোঝানো সম্ভব নয়।

গ্রামের মানুষ বলে, সেই রাতের পর থেকে যুগির গোফা আরো ভয়ংকর হয়ে উঠেছে। গুহার আশপাশে গেলে রাতে কানে ভেসে আসে চাপা চিৎকার আর কান্নার আওয়াজ। কেউ কেউ বলে, গুহার সামনে মাঝে মাঝে সাকিব, রাফি আর তুহিনের ছায়া দেখা যায়।

যুগির গোফা কি প্রাকৃতিক কোন রহস্য, নাকি সেখানে লুকিয়ে আছে অতিপ্রাকৃত শক্তির হাতছানি? সেই প্রশ্নের উত্তর হয়তো কেউই পাবে না। তবে একটাই সত্য—এই গুহার অভিশাপ থেকে কেউ মুক্ত নয়।

Post a Comment

0 Comments